সংসদে বিরোধীদল কারা অনিশ্চিত, শপথ নেবেন নির্বাচিতরা
2024.01.09
ঢাকা

সদ্যসমাপ্ত সংসদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে জাতীয় পার্টি দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক আসনে। এর প্রেক্ষিতে আসন্ন সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা কারা নেবে তা নিয়ে তৈরি হয়েছে অস্পষ্টতা।
বিশ্লেষকদের মতে, স্বতন্ত্র সদস্যদের জোট করে প্রধান বিরোধীদল হবার সুযোগ রয়েছে।
নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘পরিস্থিতি’ ও ‘বাস্তবতা’ বিবেচনায় বিরোধীদল নির্ধারণ করবেন বলে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তাঁর ওই বক্তব্যের পর দলীয়ভাবে দ্বিতীয় স্থানে থাকা জাতীয় পার্টির সংসদে প্রধান বিরোধীদল না হবার বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
তবে জাতীয় পার্টিকে বাদ দিয়ে অন্য কোনোভাবে সংসদে প্রধান বিরোধী দল গঠন করলে তা সঠিক হবে না বলে মঙ্গলবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।
তিনি বলেন, “নির্বাচনে যেসব দল আসন পেয়েছে সেগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের পরেই সর্বোচ্চ আসন পেয়েছে জাতীয় পার্টি। সরকারের বিরোধিতাকারী দল হিসাবে জাতীয় পার্টিই সংসদে বিরোধীদল হবে। এর বাইরে গেলে সেটি সঠিক হবে বলে মনে হয় না।”
“আমরা মিডিয়ায় দেখেছি, স্বতন্ত্রদের দিয়ে বিরোধীদল গঠন করা হবে। কীভাবে হবে বুঝছি না। স্বতন্ত্ররা তো কোনো দলের এমপি না,” বলেন চুন্নু।
যোগাযোগ করা হলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও রংপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচিত গোলাম মোহাম্মদ কাদের বেনারকে বলেন, “এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি-দুটি দলই আসন পেয়েছে, এখন তারাই ঠিক করুক কে বিরোধীদল হবে। এর বাইরে আমার কোনো মন্তব্য নেই।”
নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্য অনুসারে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২২২টি, জাতীয় পার্টি ১১টি ও স্বতন্ত্ররা মোট ৬২টি আসনে বিজয়ী হয়েছেন।
এছাড়া, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি করে আসন পেয়েছে। দুটি আসনে নির্বাচন স্থগিত রয়েছে।
সংসদ নির্বাচনে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচিত হবার ঘটনা এবারই প্রথম। স্বতন্ত্র হিসাবে নির্বাচিত সদস্যদের তিনজন বাদে সবাই আওয়ামী লীগ অথবা এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা।
আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্রদের সংসদ সদস্য হিসাবে বুধবার শপথ নেবার কথা রয়েছে।
স্বতন্ত্ররা হতে পারেন প্রধান বিরোধী দল
সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধিতে বিরোধীদলের সরাসরি কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন সে বিষয়ে বলা আছে।
কার্যপ্রণালী-বিধি অনুযায়ী “বিরোধীদলের নেতা” হলেন তিনি, স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত দল অথবা অধিসঙ্গের (সংগঠন/গ্রুপ) নেতা।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকায় স্বাভাবিকভাবে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধীদল হওয়ার কথা হলেও “এবার বিষয়টি ভিন্ন হতে পারে,” বলে মঙ্গলবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ।
তিনি বলেন, “হতে পারে যে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের বলতে পারেন যে তাঁরা যেন সংসদে বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করেন।”
যেহেতু স্বতন্ত্ররা বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ অথবা এরে অঙ্গ সংগঠনের নেতা সেহেতু তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুসারে “সংসদে একটি অধিসঙ্গ গঠন করতে পারেন,” জানিয়ে তিনি বলেন, “সেটি করলে এই অধিসঙ্গের নেতাই বিরোধীদলীয় নেতা হবেন।”
“আমি যতটুকু জানি ফরিদপুরের ভাঙ্গা আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন এ ব্যাপারে কাজ করছেন। তাঁর একটি বড়ো সুবিধা হলো তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় এবং একইসাথে কেন্দ্রীয় যুবলীগের নেতা। সেকারণে তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হলে আমি অবাক হব না,” বলেন কলিমউল্লাহ।
আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র সদস্যদের নিয়ে কোনো নতুন অধিসঙ্গ তৈরি করে সেটিকে সংসদে প্রধান বিরোধীদল হিসাবে স্বীকৃতি দিলে “আইনগত কোনো বাধা” আসার কথা নয় বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিজাম উদ্দিন আহমেদ।
তাঁর মতে, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের যেসব সদস্য স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন তাঁরা সংসদে “কার্যকর বিরোধীদলের ভূমিকা পালন” কিংবা সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারবেন না।
অবশ্য জাতীয় পার্টি গত দুই সংসদে প্রধান বিরোধীদল হিসাবে থাকলেও “বিরোধীদল হিসাবে কোনো কার্যকর ভূমিকাই পালন করতে পারেনি,” বলেন অধ্যাপক নিজাম।
তিনি বলেন, “তাদের কথা তো ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যদের মতোই ছিল। যদিও গোলাম মোহাম্মদ কাদের কখনও কখনও সরকার বিরোধী কথাবার্তা বলার চেষ্টা করেছেন।”
“দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে দুই একটি সংসদ বাদে সব সংসদেই বিরোধীদল তাদের ভূমিকা পালন করেনি, অথবা পালন করতে পারেনি,” যোগ করেন তিনি।

প্রায় সব সংসদেই বিরোধীদল দুর্বল ছিল
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ২৯৩টি আসনে। বাকি আসনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ও জাসদ থেকে একজন করে এবং স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত হন পাঁচজন।
১৯৭৯ সালের অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি জয় পায় ২০৭ আসনে, আওয়ামী লীগের দুই অংশ মিলে পায় ৪১টি আসন। এই সংসদে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলগুলো ছিল বিরোধীদলের ভূমিকায়। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরই সংসদ অকার্যকর হয়ে যায়।
১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি শাসনামলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৭৬ আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করে। সেই সংসদও দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে ভেঙ্গে দেয় সরকার।
১৯৮৮ সালের মার্চে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর বয়কটের মধ্যে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংসদে জাসদের একাংশের নেতা আ.স.ম. আব্দুর রবের নেতৃত্বে সম্মিলিত বিরোধীদল ১৯টি আসনে জয়লাভ করে প্রধান বিরোধীদল হিসাবে কাজ করে। এই সংসদে জাসদের (সিরাজ) তিনজন ও ফ্রিডম পার্টির দুই সদস্য ছিলেন। তখন ২৫ জন স্বতন্ত্র এমপি নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ ও বাকশাল সম্মিলিতভাবে ৯৩টি আসন নিয়ে শক্ত প্রধান বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করলেও অধিবেশন বয়কট, হরতাল, অবরোধসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে কার্যকর হয়নি সংসদ। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন তাঁরা।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিএনপির একতরফা ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো বিরোধীদল ছিল না।
একই বছর ১২ জুনে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১১৬ আসন নিয়ে বিএনপি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো বিরোধীদল হিসাবে আবির্ভূত হলেও সংসদে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। তারাও আওয়ামী লীগের মতো সংসদ বর্জন, হরতাল কর্মসূচি চালিয়ে যায়।
২০০১ সালে ৬২ আসন নিয়ে প্রধান বিরোধীদল হয় আওয়ামী লীগ। কিছুদিন কার্যকর ভূমিকা পালন করলেও বয়কট, হরতাল, অবরোধের কারণে এই সংসদে শক্তিশালী বিরোধীদল ছিল না।
২০০৯ সালে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি ৩০টি আসনে জয়লাভ করে প্রধান বিরোধীদল হয়। তবে তারা সংসদে কার্যকর ভূমিকা রাখেনি।
বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ২০১৪ সালে প্রধান বিরোধীদল হয় জাতীয় পার্টি। তবে একইসাথে দলটির তিন সদস্য মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হন। ফলে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি প্রধান বিরোধীদল।
২০১৮ সালেও প্রধান বিরোধী হয় জাতীয় পার্টি। ২০২২ সালের ডিসেম্বর সংসদ থেকে বিএনপির সাত সদস্য পদত্যাগ করলে বিরোধীদলের ভূমিকা অনেকটা হারিয়ে যায়।