টিআইবির প্রতিবেদন: সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি

অয়ন আমান
2024.01.17
ঢাকা
টিআইবির প্রতিবেদন: সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজে ব্যালট বাকশো নিয়ে যাচ্ছেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। ৬ জানুয়ারি ২০২৪।
[জীবন আহমেদ/বেনারনিউজ]

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘একপাক্ষিক’ ছিল এবং নির্বাচনী প্রতিযোগিতাও ‘পাতানো’ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদন।

বুধবার ঢাকায় টিআইবি সংস্থাটির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনের ওপর গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

অবাধ, অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত সংসদ নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়নি বলে জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়, “অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষহীন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী, একই দলের ‘স্বতন্ত্র’ ও অন্য দলের সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের যে “পাতানো খেলা” সংগঠিত হয়েছে, তাতেও ব্যাপক আচরণবিধি লঙ্ঘনসহ অসুস্থ ও সহিংস প্রতিযোগিতা হয়েছে।”

“নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পরস্পর বিপরীতমুখী ও অনড় অবস্থানের কারণে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়নি, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জিম্মিদশা প্রকট করে তুলেছে,” বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০টি সংসদীয় আসন নির্বাচন করে জুন ২০২৩ থেকে জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরির কথা জানান আয়োজকরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫০টি আসনের শতভাগ ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে আওয়ামী লীগ নিজ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করলেও অন্তত ২৪১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি।

বিভিন্নভাবে বলপ্রয়োগ

গবেষণায় বলা হয়, ৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিতে ক্ষমতাসীন দল ঘোষিত লক্ষ্য পূরণে বিভিন্নভাবে বলপ্রয়োগ করা হয়। ক্ষমতাসীন দলের সভায় না গেলে বা ভোট কেন্দ্রে না গেলে সাধারণ ভোটারসহ প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সরকারি সেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা বন্ধের হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

আবার, সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য ও পক্ষপাতমূলক কার্যক্রমে অংশ নেওয়াসহ ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন ও প্রচারণায় অংশগ্রহণের ঘটনা রয়েছে।

আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর (আওয়ামী লীগ) মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা, কর্মী ও সমর্থকের বাড়িতে হামলাসহ সহিংস ঘটনা ঘটেছে।

তফসিল ঘোষণার আগে বিরোধী দলের সক্রিয় ও নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নামে নতুন এবং পুরানো মামলায় গ্রেপ্তার ও সাজা প্রদান এবং এসব কাজে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

576626d5-0be4-45b2-962b-bc18136ba1f9.jpg
ঢাকার ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া ট্র্যাকিং' শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান (ডান থেকে দ্বিতীয়)। ১৭ জানুয়ারি ২০২৪। [মেহেদেী রানা/বেনারনিউজ]

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়া অন্য দলের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট না থাকা; প্রতিপক্ষ প্রার্থীর এজেন্টদের হুমকির মাধ্যমে কেন্দ্রে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখা, ভোটার স্বল্পতা, ডামি লাইন তৈরি, ভোট চলাকালে প্রকাশ্য সিল মারাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে।

গবেষণায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও নানাবিধ প্রশ্ন তোলা হয়ে। আগের নির্বাচনের তুলনায় ভোটার বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ হওয়া, সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস, নতুন দলের নিবন্ধন, কমিশনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি, সংলাপের প্রাপ্ত সুপারিশ আমলে নিতে নির্লিপ্ততাসহ কমিশনের কর্মকাণ্ড ঘিরে নানাবিধ বিতর্ক তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনের বাজেট বেড়ে ২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা হয়েছে, যা একাদশ নির্বাচনের তুলনায় তিনগুণ। এছাড়া নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সংসদীয় আসনে প্রতি প্রার্থীর সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ের বেঁধে দেয়া সীমাও কোনো প্রার্থী মানেননি বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে।

প্রচারে পক্ষপাত

গবেষণায় উঠে এসেছে, মোবাইলে এসএমএস প্রদান, ফেসবুকে প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারের বিবিধ উন্নয়নমূলক কাজের প্রচারণার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম বিটিভিকে একচেটিয়া ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দলের প্রচার-প্রচারণা ও সভা-সমাবেশের খবর প্রচার করা হয়েছে।

আবার বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমগুলোতে হরতাল-অবরোধ-অগ্নিকাণ্ড ও নির্বাচন বর্জনের খবরসহ বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি-সরকার দলীয় নেতাদের এমন বক্তব্য অধিক প্রচার করা হয়েছে।

৫ ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে ৫ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত বিটিভি’র রাত ৮ টার খবরে নির্বাচন সম্পর্কিত সংবাদে মোট ব্যয়িত সময় ৪৯৩ মিনিট ২৭ সেকেন্ড, যার মধ্যে সর্বোচ্চ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর খবর ১১৫ মিনিট ৫১ সেকেন্ড।

শেষ ঘণ্টার ভোট বিতর্ক

নির্বাচনে শেষের এক ঘণ্টায় ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ ভোটসহ মোট ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়া বিতর্কের জন্ম দিয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে টিআইবি।

তবে ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ ভোট শেষের এক ঘণ্টায় পড়েছে-এই তথ্য সঠিক নয় বলে জানান ‌ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।

বেনারনিউজকে তিনি বলেন, “বিকাল তিনটার সময় সংবাদ সম্মেলনে যে কথা বলা হয়েছিল ওইটা দুপুর দুইটা পর্যন্ত সময়ের তথ্য ছিল। মোট ৪২ হাজার ৩৪ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার মধ্যে ৯ হাজার ৮৮২ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ডাটা এন্ট্রি দিয়েছিল। তার ভিত্তিতে ২৭ শতাংশ ভোটের কথা বলা হয়েছিল।”

“বাস্তবে ওই সময় পার্সেন্টেজ বেশি ছিল। আমাদের অ্যাপসটা নতুন হওয়ায় অনেক প্রিসাইডিং অফিসার ওইভাবে এন্ট্রি দিতে পারেনি। কোথাও নেটওয়ার্কের জন্য দিতে পারেনি। আবার কোথাও তাদের অসচেতনতার জন্য দেয়নি। স্বাভাবিকভাবে এইখানে একটু ভেরিয়েশন তো হবেই,” বলেন তিনি।

তবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “নির্বাচন কমিশন যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে, সেটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য তার কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। এটি বিতর্কিত বিষয় এবং আমার ধারণা, এটি বিতর্কিতই থেকে যাবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।