বিরোধিতার মুখে সংসদে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিল পাশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.01.27
ঢাকা
বিরোধিতার মুখে সংসদে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিল পাশ গাইবান্ধার ফুলছড়ির একটি কেন্দ্রে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দেবার জন্য ভোটারদের সারি। ৫ জানুয়ারি ২০২২।
[ফোকাস বাংলা]

বিরোধীদলের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত দেশের প্রথম আইন পাশ হয়েছে।

এই আইন পাশের মাধ্যমে অতীতের মতো নির্বাচন কমিশন গঠনের একচ্ছত্র ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকছে না বলে বেনারকে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

তবে বিরোধীদলের মতে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনটি পাশের মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কারচুপি করতে নিজেদের পছন্দের লোকদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করবে সরকার।

বিরোধীদল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এভাবে তড়িঘড়ি করে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন দেশে সংঘাতের জন্ম দেবে, যদিও সেই সম্ভাবনা নাকচ করছে সরকার।

পাঁচ বছর মেয়াদি নুরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। এর আগেই একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চার কমিশনারের সমন্বয়ে সাংবিধানিক সংস্থা নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।

এই নতুন কমিশনের অধীনেই ২০২৩ সালের শেষে অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতিসহ সকল স্থানীয় নির্বাচন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।

উদ্দেশ্য নির্বাচনে কারচুপি করে ক্ষমতায় থাকা: বিএনপি

আইন পাশের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেনারকে বলেন, “বিএনপিসহ বিরোধীদলের সদস্যরা যেসব কথা বলছেন সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি আইন করা প্রয়োজন। কিন্তু বিগত ৫০ বছর ধরে কোনো সরকারই এই আইন পাশ করেনি। দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে আমরা এই আইন পাশ করে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছি।”

তিনি বলেন, “এই আইন অনুযায়ী দেশের সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সার্চ কমিটি ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চার নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাব করবেন এবং সেই নাম থেকে রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত নিয়োগ দেবেন।”

আনিসুল হক বলেন, “দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনের করা ড্রাফট অনুসরণ করে এই আইন পাশ করা হয়েছে। এখন থেকে একটি আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন হবে।”

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেনারকে বলেন, “তড়িঘড়ি করে এই নির্বাচন কমিশন আইন পাশ করার উদ্দেশ্য হলো, তাদের পছন্দমত রকিব উদ্দিন অথবা বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার মতো ব্যক্তিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কিছু আজ্ঞাবহ লোকদের কমিশনার পদে নিয়োগ দেয়া। এবং তাঁদের মাধ্যমে আগামী সংসদ নির্বাচনে কারচুপি করে ক্ষমতায় টিকে থাকা।”

তিনি বলেন, “এই আইন দেশের কোনো দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল মানতে পারে না। এই আইন করে কোনো লাভ হবে না, যেমনটি তারা ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল কায়েম করে কোনো লাভ পায়নি।”

এই অভিযোগের জবাবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্য শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “বিএনপি এখন বলছে ভিন্ন কথা। তারা যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের সরকার বিচারপতি আজিজ ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন জালিয়াতির মাধ্যমে করতে চেয়েছিল, নির্বাচন কমিশনকে কলঙ্কিত করেছিল।”

কী আছে আইনে?

এই আইন অনুসারে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ছয় সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। কমিটির সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক এবং সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুই জন বিশিষ্ট নাগরিক যাঁদের মধ্যে একজন হবেন নারী।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য কমিশনার হিসাবে নিয়োগ পেতে নূন্যতম ৫০ বছর বয়স্ক বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, স্বায়ত্তশাসিত, আধা সরকারি বা বেসরকারি পদে তাঁদের কমপক্ষে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

সংঘাত, বিতর্ক হবে?

সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “নির্বাচন করবে রাজনৈতিক দল। তাই নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এই আইনে রাজনৈতিক দলের কোনো অংশগ্রহণ নেই। কিন্তু সাংবিধানিক পদের কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত ব্যক্তিরা নির্বাচন কমিশন গঠনে মূল ভূমিকা পালন করবেন। সম্ভবত উনারা সবাই অরাজনৈতিক ব্যক্তি হবেন।”

তিনি বলেন, “এইভাবে না করে যদি প্রস্তাবিত সার্চ কমিটিতে সংসদ নেতা, বিরোধী দলীয় নেতাকে রাখা হতো, তাহলে সেটি আরও গ্রহণযোগ্য হতো।”

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “আমি নিশ্চিত, যখনই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে তখনই পরাজিত রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, যা দেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জন্য অশনিসংকেত।”

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “আজকে যে আইন পাশ করা হলো, সেটি আসলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো ভূমিকা রাখবে না। এটি করার মূল উদ্দেশ্য হলো, নিজেদের পক্ষে ফলাফল নেয়ার জন্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা।“

তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সৎ, যোগ্য ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি প্রয়োজন। কিন্তু এই আইনের মাধ্যমে সেটি হবে না।”

বদিউল আলম বলেন, “আর এর ফলে আগামী দিনগুলোতে নির্বাচন নিয়ে সংঘাত সৃষ্টি হবে।”

সংসদে প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বৃহস্পতিবার সংসদে বলেন, রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেয়ার কথা থাকলেও সার্চ কমিটির সুপারিশ থেকে নাম পছন্দ করবেন প্রধানমন্ত্রী এবং সেই নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন।

তিনি বলেন, সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো নাম পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই রাষ্ট্রপতির। এর অর্থ হলো, প্রধানমন্ত্রীই নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ হওয়া জরুরি। কারণ নির্বাচন আয়োজনের সকল কাজের মুখ্য ভূমিকা ইসিকেই করতে হয়। অভিযোগ আছে, গত সংসদ নির্বাচনের সময় অনেক বিদেশী পর্যবেক্ষককে দেশে আসার অনুমতি দেয়নি নির্বাচন কমিশন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।