নির্বাচন কমিশন: প্রস্তাবিত ৩২২ জনের তালিকায় বেশিরভাগই সাবেক সামরিক ও বেসামরিক আমলা
2022.02.14
ঢাকা

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য গঠিত অনুসন্ধান কমিটির কাছে জমা দেয়া ৩২২ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে সরকার, যেখানে সাবেক সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের নামের সংখ্যাই বেশি। তালিকায় তিনজন সাংবাদিক এবং আটজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার নাম এসেছে।
এ. কে. এম. নুরুল হুদার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনের পাঁচ বছরের মেয়াদ সোমবার শেষ হওয়ার দিনেই রাতে এই তালিকা ওয়েব সাইটে প্রকাশ করেছে অনুসন্ধান কমিটির সাচিবিক সহায়তা প্রদানকারী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এই ৩২২ নামের তালিকা থেকে দশজনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে অনুসন্ধান কমিটি। সেখান থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজনকে নির্বাচন কমিশনার হিসাবে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। এই কমিশনই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে।
তবে অনুসন্ধান কমিটি ওই দশ জনের নাম কবে পাঠাবে এবং সেগুলো থেকে কত দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি কমিশনারদের নাম ঘোষণা করবেন সে বিষয়ে কিছু জানায়নি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
“বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আজ শেষ হয়েছে,” মন্তব্য করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সোমবার বেনারকে বলেন, খুব তাড়াতাড়িই পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে।”
নির্বাচন কমিশন গঠনে বিলম্ব হলে আইন অনুযায়ী কোনো সমস্যা হবে না বলে জানান তিনি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ আইন অনুযায়ী, সম্প্রতি বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে সরকার।
বিদায়ী দিনেও পাল্টা সংবাদ সম্মেলন
সোমবার বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা বলেন, তিনি কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন না পেলেও অনেক দলের সমর্থন পেয়েছেন এবং কমিশন সংবিধান অনুযায়ী তাঁর দায়িত্ব পালন করেছে। তিনি বলেন, তাঁর কমিশনের সমালোচনার জন্য তিনি বিব্রত হবেন না।
নুরুল হুদা তাঁর কমিশনের অধীনে হওয়া নির্বাচনের সমালোচনা নাকচ করে বলেন, নির্বাচনের জন্য সকল রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।
অপরপক্ষে একইদিন পৃথক সাংবাদিক সম্মেলনে নুরুল হুদার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, যিনি সবসময়ই পৃথক সংবাদ সম্মেলন করে হুদা কমিশনের সমালোচনা করতেন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে কথা বলা অমূলক। মানবাধিকার নেই, মানবিক মর্যাদা নেই, গণতন্ত্র না থাকলে এসব থাকে না। বিশ্বে সম্মানজনক রাষ্ট্র হিসেবে আসীন হতে হলে গণতন্ত্রের শর্তসমূহ অবশ্যই পূরণ করতে হবে।”
মাহবুব তালুকদার বলেন, “ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, ওই নির্বাচনে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের লাশ পড়ে আছে। এই লাশ সৎকারের দায়িত্ব কে নেবে? কথাটা রূপকার্থে বলা হলেও এটাই সত্য।”
তিনি বলেন, “নির্বাচনের নামে সারা দেশে এমন অরাজকতা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। তৃণমূল পর্যায়ে এই নির্বাচন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। অন্যদিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হওয়াকে নির্বাচন বলা যায় কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।”
মাহবুব তালুকদার বলেন, “নির্বাচন কমিশনের বড়ো দুর্বলতা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনিয়ম, পক্ষপাতিত্ব, জালিয়াতি ইত্যাদি সম্পর্কে ভুক্তভোগীরা যেসব অভিযোগ করেন, সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। অধিকাংশ অভিযোগই আমলে না নিয়ে নথিভুক্ত করা হয় বা অনেক ক্ষেত্রে নথিতেও তার ঠাঁই হয় না। আমাদের কার্যকালের শেষ পর্যায়ে এসে বিগত কয়েক মাসে অবশ্য এর কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে।”
সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন?
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সোমবার বেনারকে বলেন, “আজকে যে নির্বাচন কমিশন মেয়াদ শেষ করল এই কমিশন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত কাজ করেছে। এই কমিশনের মাধ্যমে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এই নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়, মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সুপারিশে। সেকারণে তাঁরা আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছে। তবে কমিশনার মাহবুব তালুকদার ছিলেন বাকিদের চেয়ে আলাদা। উনি বার বার দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষতির দিক তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছেন। বাকিরা করেননি।”
ড. বদিউল আলম বলেন, “দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষতিসাধনের জন্য এই কমিশন জনগণের কাছে কলঙ্কিত হয়ে থাকবে।”
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ) এর প্রধান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ সোমবার বেনারকে বলেন, “এই কমিশনকে মূল্যায়ন করতে গেলে তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে মূল্যায়ন করতে হবে। তাঁদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এই নির্বাচনগুলোর মান ক্রমেই নিম্নগামী হচ্ছে যা কাঙ্ক্ষিত নয়।”
“দেশের গণতান্ত্রিক ধারার অন্যতম মূল অনুষঙ্গ নির্বাচনের মানও উন্নত হওয়া উচিত ছিল,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “পুরো নির্বাচন কমিশনের মধ্যে মাহবুব তালুকদার ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। তিনি জনগণের কথাগুলো বলতেন। এজন্য তিনি ধন্যবাদ পেতে পারেন।”
তিনি বলেন, “আজকে নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলো। আইনগতভাবে নির্বাচন কমিশন গঠনে বিলম্ব কোনো সমস্যা হবে না বলে আইনমন্ত্রী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে নির্বাচন কমিশনের অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো নির্বাচন কমিশন সচিবালয় একা করতে পারে না; কমিশনের অনুমোদন প্রয়োজন হয়।”
“আমরা আশা রাখি আইনগত দিক রক্ষা করে যত দ্রুত সম্ভব নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে,” বলেন অধ্যাপক কলিমুল্লাহ।
মাহবুব তালুকদার পদত্যাগ করলেন না কেন?
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ফারুক খান সোমবার বেনারকে বলেন, “মাহবুব তালুকদার যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো আসলে অর্থহীন। উনি বলছেন গণতন্ত্র নেই। কিন্তু কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা তো বলছেন অন্য কথা।”
মাহবুব তালুকদারের কথার কোনো “গুরুত্ব নেই,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যখন বুঝলেন যে উনি কাজ করতে পারছেন না, তাহলে পদত্যাগ করলেন না কেন? পাঁচ বছর পুরো মেয়াদ পালন করে এখন এসে বলছেন কাজ করতে পারিনি, হেরে গেছি। এগুলো ঠিক নয়।”