নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করার অভিযোগ বিরোধীদের

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.07.05
ঢাকা
নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করার অভিযোগ বিরোধীদের গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচনের পুনর্ভোটে ভোট দেয়ার প্রমাণ হিসেবে আঙুলে কালির চিহ্ন দেখাচ্ছেন এক ভোটার। ২০২২ সালের ১২ অক্টোবর আসনটির নির্ধারিত উপনির্বাচনে বেশ কিছু কেন্দ্রে জালিয়াতির কারণে পুরো আসনের ভোটগ্রহণ স্থগিত করে পুনর্ভোটের আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। ৪ জানুয়ারি ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস আগে নির্বাচনী আইন সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে দুর্বল করার অভিযোগ তুলেছে বিরোধী দলগুলো।

এই সংশোধনীর ফলে একটি সংসদীয় নির্বাচনী আসনে সহিংসতা, পেশী শক্তি প্রদর্শন এবং অন্যান্য অনিয়মের কারণে পুরো নির্বাচনী এলাকার ভোট বন্ধ করতে পারবে না কমিশন।

উল্লেখ্য, গত বছরের ১২ অক্টোবর উত্তরাঞ্চলীয় জেলা গাইবান্ধার সাঘাটা-ফুলছড়ি আসনের উপনির্বাচনে বেশ কিছু কেন্দ্রে ভোট জালিয়াতির প্রেক্ষাপটে পুরো আসনের ভোটগ্রহণ স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। তখন সরকারের পক্ষ থেকে কমিশনের এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের ওই সমালোচনার ধারাবাহিকতায় গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের সংশোধনী এসেছে।

যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দাবি করেছেন, “সংশোধিত এই আইন কোনোভাবেই নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করবে না।”

গত মঙ্গলবার রাতে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় সদস্যদের আপত্তির মুখে “রিপ্রেজেন্টেশন অব দি পিপল (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল-২০২৩” পাস হয়।

ইসির ক্ষমতা খর্ব হবে: বিরোধী দল

জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মূল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিরোধীদল বিএনপির প্রতিনিধিত্ব নেই। তবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র বলে পরিচিত এবং সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ অন্য রাজনৈতিক দলের সদস্যরা আইনটি পাস করার বিরোধিতা করেছেন।

বিলটি পাসের আগে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, এই সংশোধনীর কারণে “নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব হবে।” এবং এর ফলে এখন নির্বাচন কমিশন শুধু “সেন্টারগুলো বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু পুরো নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না।

জাতীয় পার্টির আরেক সদস্য পীর ফজলুর রহমান সংসদে বলেন, “গত বছর গাইবান্ধা উপনির্বাচনে অনিয়মের কারণে পুরো আসনের ভোটগ্রহণ বন্ধ করার কারণেই নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে।”

গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, “আপাত দৃষ্টিতে বিলটির মহৎ মনে হলেও উদ্দেশ্য ভিন্ন। নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করতে আরপিও সংশোধনের দরকার নেই—দরকার নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।”

কমিশনকে ‘দুর্বল করা হলো

বিরোধীদলীয় সদস্যদের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন।

বুধবার তিনি বেনারকে বলেন, “সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন পরিচালনার শতকরা ৮০ ভাগ দায়িত্ব হলো নির্বাচন কমিশনের। সে কারণেই শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন।” কিন্তু “গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে যে সংশোধনী আনা হলো, তাতে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে দুর্বল করা হলো।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ৯১(এ) ধারা অনুসারে যেকোনো আসনের নির্বাচন প্রক্রিয়ার যে কোনো স্তরে, বল প্রয়োগ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন অথবা অন্য কোনো চাপের কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হচ্ছে না মনে করলে নির্বাচন কমিশন “পুরো আসনের ভোটগ্রহণ বন্ধ করতে পারবে।”

কিন্তু এই ধারার সাথে সর্বশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত ৯১ (এএ) উপধারা অনুসারে কোনো নির্বাচনী আসনে “ভোটগ্রহণের (পোলিং) দিনে কোনো ভোটকেন্দ্রে শক্তি প্রদর্শন, ভয়-ভীতি প্রদর্শনসহ কোনো অনিয়ম হলে কেবলমাত্র সেই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বাতিল করতে পারবে নির্বাচন কমিশন। পুরো আসনের ভোট বাতিল করতে পারবে না,” বলেন সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি বলেন, “৯১১ (এএ) উপধারায় ‘ইলেকশন’ শব্দের পরিবর্তে ‘পোলিংশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ইলেকশন অর্থাৎ নির্বাচন শব্দটির অর্থ ব্যাপক। এর তিনটি ধাপ রয়েছে: নির্বাচনপূর্ব সময়, ভোটগ্রহণের দিন থেকে ফলাফল ঘোষণা এবং নির্বাচনোত্তর সময়। নির্বাচনপূর্ব সময় হলো, মনোনয়নপত্র দাখিল থেকে শুরু করে ভোটগ্রহণের দিন পর্যন্ত। নির্বাচনোত্তর সময় বলতে ভোটের ফলাফল সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ থেকে শুরু করে পরবর্তী ৩০ দিন পর্যন্ত।”

তাঁর মতে ‘ইলেকশন’-এর পরিবর্তে ‘পোলিং’ ব্যবহার করার ফলে “কেবলমাত্র ভোটগ্রহণের দিনে যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম হবে, সেখানেই কেবল ব্যবস্থা নিতে পারবে কমিশন। নির্বাচনের আগে কোনো প্রার্থী অপহৃত হলে অথবা ভয়-ভীতির শিকার হলে অথবা ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখালে নির্বাচন কমিশন কিছু করতে পারবে না।

“এই সংশোধনী আনার কারণ হলো গাইবান্ধা উপনির্বাচন। সেখানে বেশ কিছু কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে জালিয়াতির কারণে পুরো নির্বাচনী এলাকার ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। সেই কারণে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে অস্বস্তি প্রকাশ করা হয়,” বলেন সাখাওয়াত হোসেন।

“সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারের ওপর যখন আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে, সেই সময়ে এই ধরনের সংশোধনী ভুল বার্তা দেবে। সরকারের এই কাজ করা উচিত হয়নি,” যোগ করেন তিনি।

বিরোধী দল বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে: আইনমন্ত্রী

বিরোধী দলের অভিযোগ অস্বীকার করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে বলেন, এ বিষয়ে বিরোধী দল বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ধরুন আমার নির্বাচনী এলাকায় ১১৪টি কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে যদি পাঁচটা বা সাতটা কেন্দ্রে গণ্ডগোল হলো। কিন্তু অন্য সেন্টারগুলোতে তো মানুষ ভোট দিয়েছে, তাদের ভোটাধিকার বাতিল করার ক্ষমতা কমিশনের নেই।”

আইনমন্ত্রী বলেন, “আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনীর জন্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তাব পাঠায়।

মন্ত্রিসভায় বিষয়টি আলোচনা করে আমরা বলেছি, কয়েকটি কেন্দ্রে গণ্ডগোলের জন্য পুরো আসনের ফলাফল বাতিল করা অগণতান্ত্রিক। তখন কমিশন এর বিরোধিতা করেনি এবং এখন তারা দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না।”

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের মার্কিন ভিসা বন্ধের ঘোষণার প্রায় দেড় মাস পর নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমানো সংক্রান্ত বিলটি জাতীয় সংসদে পাস হলো।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।