ইসির সংলাপ: অধিকাংশ দল নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষে ও ইভিএমের বিপক্ষে
2022.08.01
ঢাকা

নির্বাচন কমিশন (ইসি) আয়োজিত সংলাপে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ দলই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন ও ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার না করার পক্ষে মতামত দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে রোববার ইসির সংলাপ শেষ হওয়ার পর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপরেখাসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে সংলাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলো।
কমিশন আয়োজিত আলোচনায় মোট ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে বলে বেনারকে জানান ইসির যুগ্ম সচিব এম আসাদুজ্জামান।
১৭ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই সংলাপে বিরোধী দল বিএনপিসহ নয়টি দল অংশ নেয়নি। দুটি দল তাঁদের সাথে সংলাপের সময় পুনর্নিধারণের জন্য কমিশনকে অনুরোধ করেছে বলেও জানান তিনি।
নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব
সংলাপে অংশ নেয়া ২৮টি দলের মধ্যে অন্তত ১৮টি দল নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানিয়েছে ইসি সচিবালয়।
এর মধ্যে চারটি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের সুপারিশ করেছে। নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসনসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে নির্বাচন কমিশনের অধীনে আনার প্রস্তাব করেছে ১৩টি দল।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সুপারিশ করেছে চারটি দল।
এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মিত্র রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল এবং তরিকত ফেডারেশনও নির্বাচনের সময় সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছে।
এই দলগুলো চায় নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কমিশনের হাতে থাকুক।
কমিশনের সাথে বৈঠকে গণফোরাম, জমিয়তে উলেমা-ই-ইসলাম বাংলাদেশ ও খেলাফত আন্দোলন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা বা নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে।
ইসলামী ঐক্যজোট, সাম্যবাদী দল (এমএল) এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকার পক্ষে কথা বললেও নির্বাচনকালে সরকারের কার্যক্রম সীমিত করার প্রস্তাব দিয়েছে।
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি নিবন্ধিত সব দলকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয়।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত মজলিস ও খেলাফত আন্দোলন নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় বা অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে।
এসব প্রস্তাব ছাড়াও নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচনের সময় মন্ত্রিসভা কার্যক্রমের বাইরে রাখা এবং জেলা প্রশাসকদের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব না দেওয়া জন্য জোরালো দাবি উঠেছে ইসির সংলাপে।
ইভিএমে আস্থা নেই অধিকাংশ দলের
জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ অন্তত ১৪টি দল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে মতামত দিয়ে বলেছে, মেশিনের ওপর মানুষের যথেষ্ট আস্থা নেই এবং ইভিএম ব্যবহার করলে ভোট কারচুপির সুযোগ রয়েছে। সাতটি দল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে এবং এ বিষয়ে কোনো মতামত দেয়নি সাতটি দল।
অপরদিকে নিজেদের প্রস্তাবে আগামী সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ চেয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির মতে, ভোট কারচুপি বন্ধে ইভিএমের কোনো বিকল্প নেই।
আওয়ামী লীগের এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ইভিএম নিয়ে সংকট রয়েছে জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, “বেশিরভাগ দলই ইভিএমের পক্ষে নয়। বিষয়টি নিয়ে সবাই ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি।”
আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে ইসি এখনো কোনো ‘সিদ্ধান্ত’ নেয়নি বলে জানান তিনি।
সংলাপে অংশ নেয়া দলগুলো এমন অনেক প্রস্তাবও দিয়েছে “আমাদের কাছে যেগুলোর সমাধান নেই, তবে সরকারের কাছে রয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “যে প্রস্তাবগুলো সরকারের কাছে পাঠানো দরকার আমরা সেগুলো সরকারের কাছে পাঠানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেব।”
বর্তমান ব্যবস্থায় ভোট চায় ৪ দল
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন বিদ্যমান সরকার ব্যবস্থা বহাল রেখে এই ব্যবস্থাতেই ভোট করার পক্ষে নির্বাচন কমিশনের কাছে নিজেদের প্রস্তাব তুলে ধরেছে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগসহ অন্তত চারটি দল।
সংলাপে অংশ নিয়ে রোববার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজন হবে।
“তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড চ্যাপ্টার। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এ ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক এবং অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সংবিধানের বাইরে গিয়ে ভোটের কোনো সুযোগ নেই,” বলেন কাদের।
২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তির পর ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে দশম সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে দলীয় সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই দুই নির্বাচনের প্রথমটিতে বিএনপি অংশ না নিলেও পরেরটিতে অংশ নেয়। দুটি নির্বাচনই স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক সমালোচিত হয়।
‘ইসিকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে’
প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, এটা সত্য যে সংলাপে আসা বেশির ভাগ প্রস্তাবের সুরাহা করার এখতিয়ার ইসির নেই। তবে এসব প্রস্তাব নিয়ে ইসির উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সংলাপে আসা প্রস্তাবগুলো এক ধরনের ঐকমত্য দাবি করে তিনি বলেন, একটি কার্যকর নির্বাচন করার জন্য এই প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নে রাষ্ট্রপতি বা সরকারের কাছে সুপারিশসহ পেশ করতে পারে ইসি।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের মতে, নির্বাচন কমিশন সংবিধানের বিষয় বলে প্রস্তাবগুলো সহজেই এড়িয়ে যেতে পারে, তবে প্রস্তাবগুলো নিয়ে কমিশনের কিছু করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, কমিশনকে জনগণের আস্থা অর্জনের এই সুযোগ ব্যবহার করতে হবে।
নির্বাচনকালীন সরকার ও ইভিএম ব্যবহার প্রসঙ্গে অধিকাংশের প্রস্তাবের প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বেনারকে বলেন, “সংলাপে যারা অংশ নিয়েছে তাঁরা সবাই মূলত নির্বাচনে অংশ নিবে। সংলাপে তাঁরা যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলো না দিলে মনে হতে পারে সবাই আওয়ামী লীগের মতোই চায়, তাই তাঁরা ভিন্ন কিছু বলার চেষ্টা করেছে।”
বিএনপি নির্বাচনে না আসা নিয়ে যেসব কথা বলছে সেগুলো দলটির পুরোনো রোগ দাবি করে এই প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, বিএনপি কখনো চায় না গণতন্ত্র এগিয়ে যাক, দেশের উন্নতি হোক।
সংলাপের অংশ না নেয়ার কারণ জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেনারকে বলেন, “আমরা মনে করি না, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে। অতএব, নির্বাচন নিয়ে যে কোনো ধরনের আলাপ এই মুহূর্তে অর্থহীন।”
নির্বাচন নিয়ে নয় বরং আওয়ামী লীগ পদত্যাগ করে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কী হবে তা নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে আলোচনায় বসতে রাজি বিএনপি, বলেন ফখরুল।
আগামী বছরের শেষে অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।