নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ, ইসির ওপর আস্থা নেই বিরোধীদের

আহম্মদ ফয়েজ
2022.09.14
ঢাকা
নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ, ইসির ওপর আস্থা নেই বিরোধীদের নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মুখে কালো কাপড় বেঁধে ঢাকায় বামপন্থী দলগুলোর সমাবেশ। ৩ জানুয়ারি ২০১৯।
[রয়টার্স]

নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান আন্দোলনের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

কমিশনের এই কর্মপরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে বিরোধী দল। নির্বাচন কমিশন বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়।

উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালের পর সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয় এবং এর মাধ্যমে কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে।

বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকবে। তার মানে বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার সুযোগ নেই।

নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুধবার বলেন, “এই সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।”

এদিকে বুধবার ইসির প্রকাশিত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বরে আগামী সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে এবং একই বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

অসুস্থতাজনিত কারণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) উপস্থিত না থাকায় রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে ইসির কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবীব খান।

তিনি বলেন, এই কর্মপরিকল্পনার একমাত্র উদ্দেশ্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজন করা।

তিনি জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি মাস থেকে নির্বাচন পর্যন্ত কী কী কার্যক্রম চলবে তা নির্ধারণ করা হয়েছে। এবার নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হবে। এজন্য আগের নীতিমালা পর্যালোচনা করে আগামী বছরের জানুয়ারিতে নতুন নীতিমালা তৈরি করা হবে।

ইসি কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ও অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপের সময় সংবিধানের আলোকে যেসব সুপারিশ এসেছে সেগুলো নেওয়া হয়েছে। সংবিধান সম্মত না হওয়ায় বেশ কিছু পরামর্শ নেয়া সম্ভব হয়নি।

ইভিএমে ভোট হবে শহরে

আগামী সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের আপত্তি থাকলে কর্মপরিকল্পনায় ইসি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে সর্বমোট ৩০০ আসনের সর্বোচ্চ ১৫০টিতে ইভিএম ব্যবহার করবে ইসি।

ইভিএম ব্যবহার হলে নির্বাচনে অনিয়ম হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে জানিয়ে আলমগীর বলেন, “সামর্থ্য থাকলে আমরা সবগুলো আসনেই ইভিএম ব্যবহার করতাম।”

নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান জানান, সব অংশীজনের সহযোগিতা দরকার। বাস্তবভিত্তিক ও সময়ভিত্তিক এ রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে ভোট করার বাধ্যবাধকতা তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, এ কর্মপরিকল্পনায় সবার মতামত রাখার চেষ্টা করেছি আমরা। যেসব বিষয় আমাদের আওতায় রয়েছে তা রাখা হয়েছে। তবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সুপারিশগুলো রাখা হয়নি।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান নির্বাচন কমিশন তার চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করেছে। একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়ও নির্ধারণ করেছে ইসি। কমিশনের মতে, তাদের সামনে রয়েছে ১৩টি চ্যালেঞ্জ এবং এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের ১৯টি করণীয় রয়েছে।

ইসির চোখে নিজেদের সংকট ও উত্তরণের পথ

কমিশনার আহসান হাবিব বলেন, ইসির চ্যালেঞ্জগুলো হলো; নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি; নির্বাচনের দায়িত্বে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের, বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন; ব্যবহৃত ইভিএম এর প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি; অর্থ ও পেশীশক্তির নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা।

তিনি আরো চ্যালেঞ্জের বিষয়ে বলেন, সকল রাজনৈতিক দল কর্তৃক নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসরণ; নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে বিপক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, সমর্থক, পুলিশ, প্রশাসন কর্তৃক কোনোরকম বাধার সম্মুখীন না হওয়া; জালভোট, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই রোধ; প্রার্থী, এজেন্ট, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে অবাধ আগমন এবং ভোটারদের পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থীকে ভোট প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি।

তিনি বলেন, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান; পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত করা; পর্যাপ্ত সংখ্যক নির্বাহী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত করা এবং নিরপেক্ষ দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োজিত করা ইসির চ্যালেঞ্জ।

এসব চ্যালেঞ্জ উত্তরণের ১৯টি উপায় বের করেছে ইসি।

উত্তরণের এসব পথের মধ্যে রয়েছে অংশীজনের সাথে সংলাপ, আইনের সংস্কার, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতা বাড়াতে ব্যাপক প্রচারণা।

সব দল নির্বাচনে অংশ নেবে: প্রধানমন্ত্রী

এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি আশা করেন আগামী নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে এবং সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে।

তিনি আরও বলেন, “সবাই ইলেকশনে পার্টিসিপেট করুক সেটাই আমরা চাই। তবে যদি কেউ না করে সেটা যার যার দলের সিদ্ধান্ত। সে জন্য আমরা সংবিধান তো বন্ধ করে রাখতে পারি না। আমরা চাই সংবিধান অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকবে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকবে।”

এসময় তিনি বলেন, “জোট-ভোটের বিষয়টি সময় এলে বলা যাবে। আমরা ১৪ দল করেছি। জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করেছি। জাতীয় পার্টি আলাদাভাবে নির্বাচন করেছে। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের একটি সমঝোতা ছিল। ভবিষ্যৎ নির্বাচনে কে কোথায় থাকবে তা সময় বলে দেবে।“

ইসির সমালোচনায় বিরোধীরা

নির্বাচন কমিশনের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেনারকে বলেন, “এই নির্বাচন কমিশন কী করল বা না করল তা নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই।”

নির্বাচন কমিশনের কর্মপরিকল্পনাকে মূল্যহীন দাবি করে জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বেনারকে বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষমতা এই নির্বাচন কমিশনের নেই।”

তিনি বলেন, আইনে আছে, নির্বাচনের সময় দেশের নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনের অধীন কাজ করবে। কিন্তু নির্বাহী বিভাগ যদি নির্বাচন কমিশনের কথা না শোনে, তাহলে কী হবে, তা বলা নেই। তাই নির্বাচন কমিশনের কথা নির্বাহী বিভাগ মানতে বাধ্য নয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “এই কর্মপরিকল্পনা মূলত আরেকটি ব্যর্থ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা। এই রূপরেখার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা তো দূরের কথা, পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।”

তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা, ইভিএম বিতর্কের অবসান ও রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

বয়কট ও অনিয়মের কারণে গত দুটি সাধারণ নির্বাচন দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়লেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।