চারদিনের মধ্যে তিনটি এশিয়ান হাতি হত্যা, বন বিভাগের তিন মামলা
2021.11.11
ঢাকা

শনিবার থেকে মঙ্গলবার-এই চার দিনে দেশের তিনটি স্থানে তিনটি বিপন্ন এশিয়ান হাতি প্রাণ হারানোর পর হাতি রক্ষায় নড়েচড়ে বসেছে সরকারের বন বিভাগ।
সরকারের বন বিভাগের বন সংরক্ষক মোল্লা রেজাউল করিম বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, হাতি তাড়াতে অবৈধভাবে গ্রামবাসীদের স্থাপিত বিপজ্জনক বৈদ্যুতিক তারের সাথে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় শনিবার এবং শেরপুরের শ্রীবর্দী উপজেলায় মঙ্গলবার দুটি হাতি মারা গেছে।
তিনি জানান, সর্বশেষ মঙ্গলবার ভোরে কক্সবাজারের চকোরিয়া উপজেলায় খুটাখালী ইউনিয়নের পূর্ণগ্রাম বন বিটের হাইথারা ঘোনায় গুলি করে আরেকটি হাতিকে হত্যা করা হয়।
চকোরিয়ায় হাতি হত্যার দায়ে হাতেনাতে ধৃত মংলা মারমা (৪২) নামের একজনকে আদালতে সোপর্দ করা হলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে কক্সবাজার বন বিভাগের এক চিঠিতে জানা গেছে।
মোল্লা রেজাউল করিম বলেন, “আমরা এই তিনটি হাতি হত্যার অভিযোগে তিনটি আলাদা মামলা দায়ের করেছি এবং অবৈধভাবে স্থাপিত বিদ্যুতের তার তুলে ফেলেছি। হাতি রক্ষায় সকল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
শেরপুর জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রুহুল আমিন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচতে শেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষ বাড়ির আশেপাশে বৈদ্যুতিক তার দিয়ে চারদিক ঘিরে দেয়। হাতি যখন আসে তখন তারা বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়। হাতি সাধারণত বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চলে যায়।
তিনি বলেন, “মঙ্গলবার একটি হাতির মৃত্যুর পর আমরা ওই এলাকার সকল বৈদ্যুতিক তার সরিয়ে ফেলেছি।”
মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে কারো নাম দেয়া হয়নি জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা নিশ্চিত হতে চাই কার বাড়ির তারে জড়িয়ে হাতিটি মারা গেছে। নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে।”
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি হাতি হত্যা করলে দুই বছর থেকে সাত বছর কারাদণ্ড অথবা এক থেকে দশ লাখ টাকা দণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই আইনের আওতায় হাতি হত্যার মামলাটি জামিন অযোগ্য।
সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি একই অপরাধ আবার করলে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
তবে আইন অনুযায়ী, জীবন রক্ষার্থে কেউ হাতি হত্যা করলে এই আইন প্রযোজ্য হবে না।
দুই বছরে ২৫ হাতি হত্যার শিকার
বন্য হাতির দল লোকালয়ে ঢুকে গ্রামবাসীর বাড়িঘরে আক্রমণ চালায় এবং ফসল খায় এবং নষ্ট করে। সেকারণে মানুষের সাথে হাতির সংঘাত বাড়ছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে, মার্কিন সরকারের অর্থ সহায়তায় বাংলাদেশে বনভূমি রক্ষার জন্য গঠিত সংগঠন আরণ্যক ফাউন্ডেশনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন অন্য কথা।
তিনি বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “হাতি একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বিচরণ করে এবং তারা দলবদ্ধ হয়ে একটি নির্দিষ্ট করিডোর দিয়ে চলাফেরা করে। বাংলাদেশে যেসব এলাকায় হাতি দেখা যায়, সেগুলো বাংলাদেশ-ভারত, বাংলাদেশ-মিয়ানমার উভয় দেশেই চলাচল করে। কারণ তারা তো কোনো দেশের প্রাণী নয়।”
গত দুই বছরে কমপক্ষে ২৫টি হাতি মানুষের হাতে নিহত হয়েছে। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন ও বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে চলতি বছর ১১টি হাতি মেরে ফেলা হয়েছে।
ফরিদ উদ্দিন বলেন, “প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দুই বছরে ২৫ টি হাতি মৃত্যুর ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। দুঃখের বিষয়, আমরা সবাই মিলে হাতির আবাসস্থল এবং হাতি চলাচলের করিডোর নষ্ট করেছি। সেখানে মানুষ বাড়িঘর নির্মাণ করেছে, চাষাবাদ শুরু করেছে। আর সেকারণেই হাতির সাথে মানুষের সংঘাত হচ্ছে।”
হাতির অবাসস্থল নষ্টের উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, “যেমন কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলায় যেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়েছে সেই স্থান এবং রামুর পাহাড়ি জঙ্গলে হাতিদের আবাসস্থল ছিল। সেখানকার বন কেটে ফেলা হয়েছে। সেকারণে হাতিরা আক্রমণাত্মক হচ্ছে। ভবিষ্যতে হাতির সাথে মানুষের সংঘাত বাড়বে।”
প্রতি বছরই হাতির আক্রমণ বাড়ছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ-ভারত পাহাড়ি সীমান্ত এলাকা শেরপুরের শ্রীবর্দী ও ঝিনাইগাতি উপজেলা, কক্সবাজার জেলার উখিয়ায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশে চলাচল করে এশিয়ান এলিফ্যান্ট প্রজাতির হাতি।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর ২০১৬ সালের জরিপে এশিয়ান এলিফ্যান্টকে ‘মারাত্মক সংকটাপন্ন’ প্রাণী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এই জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা ২৬০ থেকে ২৬৮। সেখানেও বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপে হাতির আবাসস্থল ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।
এশিয়ান এলিফ্যান্ট বিশ্বের ১৩টি দেশে দেখা যায় এবং প্রজাতি সারাবিশ্বেই সংকটাপন্ন।
শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান জুয়েল আকন্দ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “একথা সত্য আমাদের অঞ্চলে যে হাতির আবাসস্থলের কাছে মানুষের বসবাস রয়েছে। আমাদের জেলার শ্রীবর্দী ও ঝিনাইগাতি উপজেলা পাহাড়ি অঞ্চল। এই দুই উপজেলায় ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত মানুষের বসবাস রয়েছে।”
তিনি বলেন, “সাধারণত বছরের এই সময়ে বন্য হাতির দল বেশি করে ভারতীয় সীমান্তের ওপার থেকে আমাদের অঞ্চলে প্রবেশ করে। কারণ এই সময় ধান পাকে।”
জুয়েল আকন্দ বলেন, “একেক দলে কমপক্ষে বড়-ছোট মিলিয়ে ৪০টি হাতি থাকে। হাতিগুলো যতটুকু খায়, তার চেয়ে বেশি ফসল নষ্ট করে। ফসল বাঁচাতে গিয়ে গ্রামের মানুষ হাতির সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়।”
তিনি বলেন, “এই সংঘাত পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসছে। প্রতিবছর দু-একজন মানুষ হাতির আক্রমণে মারা যায়।”
তিনি বলেন, “সেকারণে অনেকে হয়তো বিদ্যুতের তার দিয়ে নিজেদের রক্ষা করে। হাতি বাঁচাতে হবে-সেটি ঠিক আছে। কিন্তু আসলে মানুষের জীবন তো আগে।”
শ্রীবর্দী উপজেলা চেয়ারম্যান এ ডি এম শহিদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “হাতি পাহাড় থেকে আমাদের গ্রামের দিকে নেমে আসার কারণ খাদ্যাভাব। আগে হাতির আক্রমণ এত প্রকট ছিল না। প্রতি বছরই হাতির আক্রমণ বাড়ছে। এর কারণ পাহাড়ে তাদের খাবার তেমন নেই। সেকারণে তারা পাহাড় থেকে নেমে কৃষকের ফসল নষ্ট করে।”
তিনি বলেন, “এ ছাড়া, পাহাড়ে বন প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের আবাসস্থল নষ্ট হয়েছে। এ জন্য আমাদের বন বিভাগ অনেকাংশে দায়ী।”
বন সংরক্ষক মোল্লা রেজাউল করিম বেনারকে বলেন, “হাতি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও প্রতিশোধপরায়ণ প্রাণী। কেউ তাকে একবার আক্রমণ করলে তারা অনেকদিন পর্যন্ত সেই আক্রমণকারীকে চিনে রাখে এবং আক্রমণ করে।”
তিনি বলেন, “গ্রামবাসীদের আমরা বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার বন্ধ করাতে পারছি না। এর অন্যতম কারণ জনবল সংকট। স্বল্প সংখ্যক জনবল দিয়ে হাতি রক্ষা কঠিন।”
তিনি বলেন, “যখনই বৈদ্যুতিক তার ব্যবহারের বিষয়টি আমাদের নজরে আসে আমরা সেগুলো অপসারণ করি।”