শকুন রক্ষার জন্য গবাদিপশুর চিকিৎসায় ‘কিটোপ্রোফেন’ নিষিদ্ধ ঘোষণা

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.02.08
ঢাকা
শকুন রক্ষার জন্য গবাদিপশুর চিকিৎসায় ‘কিটোপ্রোফেন’ নিষিদ্ধ ঘোষণা ঢাকা চিড়িয়াখানায় শকুনকে খাবার দিচ্ছেন এক কর্মী। ১৩ মার্চ ২০১৭। ফাইল ছবি।
[স্টার মেইল]

প্রকৃতির ঝাড়ুদার হিসাবে পরিচিত মহাবিপন্ন পাখি শকুন রক্ষায় গবাদিপশুর চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত বিষাক্ত ওষুধ ‘কিটোপ্রোফেন’ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাংলাদেশে এই ওষুধের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে সাংবাদিকদের জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। 

গবাদিপশুর চিকিৎসায় কিটোপ্রোফেনের ব্যবহার বন্ধ করে এর পরিবর্তে ‘ম্যালক্সিক্যাম’ ব্যবহারের অনুমতি দিতে প্রস্তাব দেয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়। সেই অনুযায়ী, মন্ত্রিসভা এই সিদ্ধান্ত নেয়। 

খন্দকার আনোয়ারুল বলেন, “আমাদের দেশে শকুনের সংখ্যা কমে গেছে, এটি খুবই বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে।” 

“সত্তরের দশকে দেশে ৫০ হাজারের মতো শকুন ছিল। এখন তাদের (মন্ত্রণালয়) হিসেবে মাত্র ২৬০টি আছে। তাও সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। এর অন্যতম কারণ কিটোপ্রোফেন জাতীয় ব্যথানাশকের ব্যবহার, এই ওষুধ শকুনের মধ্যে গেলে মারা যায়।” 

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, ফার্মাসিউটিক্যালস, ড্রাগ কোম্পানি ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, কিটোপ্রোফেন বন্ধ না হলে শকুন এ দেশে বাঁচবে না। 

পরিবেশবিদদের মতে, শকুন পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে সহায়তা করে। কোনো প্রাণী মারা গেলে দলে দলে শকুন এসে রাতারাতি সেই প্রাণীর মাংস খেয়ে প্রকৃতি পরিষ্কার রাখে। 

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) মতে, বাংলাদেশে শকুন মহাবিপন্ন প্রাণী। বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার শতকরা ৯৯ ভাগ শকুন হারিয়ে গেছে। 

এর কারণ হিসাবে গবাদিপশুর চিকিৎসায় ব্যথানাশক ‘ডাইক্লোফেনাক’ এর ব্যবহারকে দায়ী করা হয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশে ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করে সরকার। এর পরিবর্তে শুরু হয় কিটোপ্রোফেনের ব্যবহার। 

আইইউসিএন বলছে, ডাইক্লোফেনাকের মতো কিটোপ্রোফেনও শকুন ধ্বংসে ভূমিকা রাখছে। 

আইইউসিএন–এর শকুন প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সীমান্ত দিপু বেনারকে বলেন, “গবাদিপশুর চিকিৎসার জন্য ২০১০ সালের আগে ডাইক্লোফেনাক ও তার পর থেকে  কিটোপ্রোফেন ব্যবহার করা হচ্ছিল। যেসব পশুর চিকিৎসায় এই দুটি ওষুধ প্রয়োগ করা হতো সেসব পশু মারা গেলে এর মাংস খেয়ে শকুনগুলো মারা যেত।” 

তিনি বলেন, “গবাদিপশুর শরীরে থাকা ডাইক্লোফেনাক শকুনের কিডনি নষ্ট করে দেয়। আর কিটোপ্রোফেন শকুনের শরীরে প্রবেশ করলে শকুনের রক্তের কোষ ভেঙে যায় এবং শকুনগুলো তাড়াতাড়ি মারা যায়।” 

দিপু বলেন, সরকার ২০১০ সালে ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করে। এখন কিটোপ্রোফেন নিষিদ্ধ করায় তা শকুনের অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়ক হবে। 

“আমরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। এর মাধ্যমে দেশে শকুনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব হবে,” যোগ করেন তিনি। 

ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০১৪ সাল থেকে সিলেট সীমান্তে এবং সুন্দরবন এলাকায় দুটি অভয়ারণ্য সৃষ্টি করে বনবিভাগ। ওই দুটি এলাকায় কিটোপ্রোফেন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশের যে ২৬০ টি শকুন রয়েছে তার মধ্যে সিলেট অঞ্চলে আছে ১০০টি এবং সুন্দরবন অঞ্চলে আছে ১০০টি। দেশের বাকি জায়গায় রয়েছে মাত্র ৬০টি শকুন। 

কিটোপ্রোফেন বন্ধ করার ফলে অভয়ারণ্যে শকুনের সংখ্যা আর কমেনি বলে জানান দিপু। 

বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিলের উপ-রেজিস্ট্রার গোপাল চন্দ্র বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে গবাদিপশুর খামারের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। তাই, গবাদিপশুর চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। আমরা আগে পশুর ব্যথা, ফুলে যাওয়া এবং জ্বর সারাতে ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম ব্যবহার করতাম। শকুন রক্ষার জন্য ২০১০ সালে সরকার ডাইক্লোফেনাক ব্যবহার বন্ধ করে দেয়।” 

“এরপর থেকে আমরা ডাইক্লোফেনাক সোডিয়ামের পরিবর্তে কিটোপ্রোফেন ব্যবহার করি। কিটোপ্রোফেন একইসাথে পশুর জ্বর, ব্যথা এবং ফুলে যাওয়ার চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়,” জানান তিনি। 

ওই চিকিৎসকের মতে, এখন এটি যদি বন্ধ করা হয় তাহলে কিটোপ্রোফেনের পরিবর্তে তিনটি ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। তাতে খামারিদের খরচ বেড়ে যাবে এবং পশুদের আরও যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। 

গোপাল বলেন, “আমি মনে করি এই অবস্থায় কিটোপ্রোফেন বন্ধ করার দরকার নেই। কারণ, আগের মতো মানুষ আর মরা গবাদিপশু মাঠে–ময়দানে ফেলে রাখে না। অনেক খামারি মৃত পশুপাখি পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে মাটির নিচে  পুঁতে রাখে।” 

তিনি বলেন, আকার ভেদে গড়ে প্রতিটি গবাদিপশুর জন্য বছরে ৫০ মিলিলিটার কিটোপ্রোফেন ব্যবহৃত হয়। 

বাংলাদেশে বন রক্ষায় মার্কিন-বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত আরণ্যক ফাউন্ডেশনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “কিটোপ্রোফেন ব্যবহার বন্ধ করা সরকারের একটি ভালো পদক্ষেপ। এর ফলে শকুনের সংখ্যা বাড়বে সন্দেহ নেই।” 

তিনি বলেন, “শকুন রক্ষা ছাড়াও, আমরা কিটোপ্রোফেন প্রয়োগ করা পশুর মাংস খাই। কিটোপ্রোফেনের ক্ষতিকর উপাদান খাদ্যের মাধ্যমে আমাদের শরীরে চলে আসে। কিটোপ্রোফেন বন্ধ হলে তা মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।