পরিবেশ রক্ষায় জনস্বার্থে ৩০০ মামলা লড়েছেন রিজওয়ানা, যুক্তরাষ্ট্রে 'সাহসী নারী' পুরস্কার গ্রহণ

জেসমিন পাপড়ি
2022.03.14
ঢাকা
পরিবেশ রক্ষায় জনস্বার্থে ৩০০ মামলা লড়েছেন রিজওয়ানা, যুক্তরাষ্ট্রে 'সাহসী নারী' পুরস্কার গ্রহণ ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আয়োজিত উইমেন অব কারেজ পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত রিজওয়ানা হাসানের ছবি। ১৪ মার্চ ২০২২।
[সরাসরি সম্প্রচারিত পুরস্কার বিতরণ ভিডিওর স্ক্রিনশট]

পরিবেশগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও জনমানুষের পরিবেশগত অধিকার নিশ্চিতে ব্যতিক্রমী সাহসিকতা ও আইনি লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

জনস্বার্থে তাঁর করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০৯ সালে একটি যুগান্তকারী রায়ে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া সমস্ত জাহাজ ভাঙা বন্ধ করার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে মারাত্মক ক্ষতিকর এই শিল্পের জন্য বিধিমালা প্রবর্তন করতে বাধ্য করে। জাহাজ-ভাঙা শিল্পের পরিবেশ-দূষণ ও শ্রমিকদের মৃত্যুঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে তাঁর আইনি লড়াই বিশ্ববাসীর দৃষ্টিও আকর্ষণ করে।

১৯৯৩ সাল থেকে পরিবেশ, শ্রমিক এবং আদিবাসীদের সুরক্ষার জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টায় জনস্বার্থে প্রায় ৩০০ মামলা দায়ের করেছেন তিনি।

রাজধানী ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি শিল্প কারখানাগুলো স্থানান্তরিত হওয়ায় কিছুটা হলেও দূষণ কমেছে ঢাকার প্রাণ হিসেবে পরিচিতি বুড়িগঙ্গা নদীর। তবে এই স্থানান্তর অত সহজ ছিল না।

দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে আইনি লড়াইয়ের ফলে এই সাফল্য আসে। আর লড়াইয়ের নেপথ্যে ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

এছাড়া জলাশয় ভরাট করে আবাসন তৈরি, কৃষকের জমি দখল করে অর্থনৈতিক জোন তৈরি, পলিথিনের ব্যবহার, পাহাড় কাটা, বন ধ্বংসসহ নানা ক্ষেত্রে যেখানেই পরিবেশের ক্ষতি সাধিত হচ্ছে বা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সেখানেই পরিবেশ রক্ষায় আইনিভাবে এগিয়ে এসেছেন আইনজীবী রিজওয়ানা হাসান।

যার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন বারবার। সর্বশেষ এই পরিবেশ আইনজীবীর ঝুলিতে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্তর্জাতিক সাহসী নারী পুরস্কার (উইমেন অব কারেজ)।

সৈয়দা রিজওয়ানাসহ বিশ্বের ১২ জন নারী এ বছর এই পুরস্কার পেয়েছেন।

রিজওয়ানা হাসান মনে করেন, এ স্বীকৃতি এসেছে মূলত পরিবেশ বিষয়টিকে বাংলাদেশে একটি এজেন্ডা করার কারণে।

তবে আন্তর্জাতিক সাহসী নারী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আনন্দের পাশাপাশি আরো বেশি কাজ করার তীব্রতা অনুভব করছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন রিজওয়ানা হাসান।

এক প্রতিক্রিয়ায় রিজওয়ানা বলেন, “পুরস্কার পাওয়া সব সময়ের জন্য আনন্দের ব্যাপার। বিশেষ করে আপনার কাজগুলো পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকেও কেউ খেয়াল করছে সেটা অনেক বেশি খুশির বিষয়। একইসঙ্গে সেটা অনেক বেশি দায়িত্বেরও ব্যাপার। কারণ, যত আপনি স্বীকৃতি পান তত সতর্ক এবং আরো বেশি কর্মতৎপরও হতে হয়। থামার বা বিশ্রাম নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।”

শান্তি, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, লৈঙ্গিক সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নে অবদান রাখায় নারীদের এই পুরস্কার দিয়ে থাকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। ২০০৭ সালে চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৮০টি দেশের ১৭০ জন সাহসী নারী এ পুরস্কার পেয়েছেন।

বাংলাদেশিদের মধ্যে এর আগে ২০১৭ সালে বাল্য বিবাহ ও জোরপূর্বক বিয়ের বিরুদ্ধে উদ্যোগের জন্য এই পুরস্কার পেয়েছিলেন ঝালকাঠির কিশোরী শারমিন আক্তার ও ২০১৫ সালে ঢাকার সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন।

ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আয়োজিত উইমেন অব কারেজ পুরস্কার বিতরণের ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন। ১৪ মার্চ ২০২২। [রয়টার্স]
ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আয়োজিত উইমেন অব কারেজ পুরস্কার বিতরণের ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন। ১৪ মার্চ ২০২২। [রয়টার্স]

নারীরা কখনই নীরব থাকেনি: জিল বাইডেন

সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক সাহসী নারী পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করেন, যেখানে বক্তব্য রাখেন ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন।

তিনি বলেন, শিশুদের ঘুম পাড়ানো কমনীয় সংগীতের সুর থেকে থেকে যুদ্ধ পর্যন্ত ন্যায়ের জন্য আর্তনাদে নারীরা প্রতিদিন প্রতিটি ক্ষণ সেবা দেয় ও লালনপালন করে, শেখায় ও নির্মাণ করে; আমাদের বিশ্বকে এগিয়ে নিতে নেতৃত্ব দেয় এবং স্বপ্ন দেখায়।

“নারীরা কখনই নীরব থাকেনি; কিন্তু তাদের নীরব করে দেওয়া হয়েছে সহিংসতায়, ঘৃণায়, বৈষম্যে ও বিচ্ছিন্নতায় মধ্য দিয়ে। তাদের কাজ এবং প্রযত্ন উপেক্ষিত হয়েছে,” বলেন জিল বাইডেন।

তিনি বলেন, “নারীদের বলা হয়েছে, তারা বিপজ্জনক এবং আসলেই তাই, কারণ তারা দুর্নীতি ও অবিচারের জন্য বিপজ্জনক। আমরা যখন আমাদের আওয়াজ তুলি, তখন নিপীড়নের ঢাল ভেঙে দেওয়ার আমাদের শক্তি থাকে।”

“সাহসী সকল নারী —যারা লাতিন আমেরিকায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন বা মধ্যপ্রাচ্যে শিখার আশা করছেন, ইউরোপে গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার জন্য কাজ করছেন, সাব-সাহারান আফ্রিকায় তাদের পরিবারকে রক্ষা করছেন বা এশিয়ায় লিঙ্গ সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন — আমরা আবেগ এবং অধ্যবসায়ের সাথে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের পথে কাজ করতে এবং যারা আপনাকে নীরব করে দিতে চায় তাদের থামাতে কাজ চালিয়ে যাব,” বলেন তিনি।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সাহসী নেতৃত্ব

নিজের কাজ সম্পর্কে রিজওয়ানা হাসান বলেন, “মূলত আমরা (তিনি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান) আইনি সহায়তা দিই। নানা রকম পরিবেশ ক্ষতির মুখে পড়া মানুষ স্বার্থগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না, এমন মানুষদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় আমরা আইনি সহায়তা দিই। তাদের বড়ো একটি অংশ দরিদ্র এবং নারী।”

মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি আইনজীবী রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় সাহসী নেতৃত্ব দেখিয়েছেন। গত ২০ বছর ধরে যুগান্তকারী আইনি মামলার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিশীলতা পরিবর্তন করে পরিবেশগত ন্যায়বিচারের ওপর জনকেন্দ্রিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন।

এতে বলা হয়, জনস্বার্থ আইন সংস্থা বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী হিসেবে বন উজাড়, দূষণ, অনিয়ন্ত্রিত জাহাজ ভাঙা এবং অবৈধ ভূমি উন্নয়নের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ মামলা লড়েছেন এবং জিতেছেন।

২০০৯ সালে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বের ৪০ জন এনভায়রমেন্টাল হিরোর একজন হিসেবে মনোনীত হন এবং ২০১২ সালে র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারে ভূষিত হন। শক্তিশালী মহলের প্রতিরোধ ও নিজের এবং পরিবারের প্রতি সহিংসতার হুমকি সত্ত্বেও বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের স্থানীয় প্রভাবগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে আদালতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

তাঁর দীর্ঘদিনের লড়াই সম্পর্কে জানতে চাইলে রিজওয়ানা হাসান বলেন, “বাংলাদেশ শুধু নয় পৃথিবীর কোথাও পরিবর্তনের যাত্রা খুব সহজ হয় না। যারা কয়লা, গ্যাস, জমি জলাশয়ের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ কুক্ষিগত করতে চায় বা এগুলোকে দুষিত করে ধ্বংস করে নিজেদের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চায় তাদের বিরুদ্ধেই আমাদের দাঁড়াতে হয়।”

“আমাদের মতো দেশে যেখানে আইনের শাসনের ইন্ডিকেটর খুবই নিচের দিকে, সেখানে এটা আমাদের জন্য বাড়তি ঝুঁকি হয়ে যায়।”

“কিন্তু এই ঝুঁকিটা আমরা অতিক্রম করতে পারি কারণ, আমাদের সাথে সমাজের মূল ধারা থাকে। বড়ো জনগোষ্ঠী এবং মূল ধারার মিডিয়ার সমর্থনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলও আমাদের উপর নজর রাখে। মানুষের কাছ থেকে পাওয়া শক্তি দিয়েই আমরা ঝুঁকিগুলোর মোকাবেলা করে যাই,” বলছিলেন পরিবেশ কর্মী রিজওয়ানা হাসান।

রিজওয়ানা হাসানের এই অর্জনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আরেক পরিবেশ কর্মী ও আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।

তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে মনজিল বলেন, “পরিবেশ সংরক্ষণে সৈয়দা রিজওয়ানা এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান বেলার অবদান অনেক। পরিবেশ বিরোধী কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন রকম অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সোচ্চার থেকেছেন। তার অবদানের এই রকম স্বীকৃতি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে পুলক ঘটক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।