নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি হিযবুত তাহরীরের, কঠোর অবস্থানে সরকার
2024.10.08
ঢাকা

সরকার পতন আন্দোলনের অংশীদার দাবি করে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আবেদন জানিয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর। সরকার সেই আবেদন বিবেচনায় না নিয়ে দলটির পক্ষে প্রকাশ্য প্রচারে অংশ নেওয়া এক শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে উগ্রবাদী হিসেবে পরিচিত এই সংগঠনটি রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের এই সুযোগ দেওয়া হলে উগ্র জঙ্গিবাদের বিস্তার হতে পারে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ পিস এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক শাফকাত মুনীর বেনারকে বলেন, “নিষিদ্ধ ঘোষিত সংস্থা হিযবুত তাহরীরের বর্তমান যে তৎপরতা, তা নিয়ে আমরা বেশ উদ্বিগ্ন। কারণ, আরো যেসব নিষিদ্ধ সংগঠন আছে, তারাও এখন প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাতে পারে।”
হিযবুত তাহরীরকে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি উল্লেখ করে শাফকাত মুনীর বলেন, “সংগঠনটি প্রকাশ্যে কোনো জঙ্গি হামলাকে সমর্থন করে না। তবে তাদের আদর্শ, চিন্তাধারা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অন্যান্য সহিংস উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর সাথে তাদের মতাদর্শে বড়ো কোনো পার্থক্য নেই।”
২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সংগঠনটির কার্যক্রম দেশের শান্তি শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত হওয়ায় এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার কথা সরকারের প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয়।
তারপর থেকে দলটি গোপনে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
কালো পতাকা মিছিল ঘিরে রহস্য
হিযবুত তাহরীর মতো নিষিদ্ধ সংগঠনের তৎপরতার মধ্যে সম্প্রতি ঢাকা ও এর বাইরে কয়েকটি স্থানে বিভিন্ন মিছিলে ‘কালিমা’ তাইয়েবা লেখা কালো পতাকা দেখা গেছে। যেখানে কথিত ইসলামিক স্টেটের (আইসিস) পতাকা ছিল বলে নিশ্চিত করেছেন ফ্যাক্ট চেকাররা।
গত সপ্তাহে রাজধানী ঢাকায় নটরডেম কলেজ, ঢাকা কলেজ, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থীদের ওইরকম কালো পতাকা হাতে মিছিল করতে দেখা যায়। কারো কারো হাতে সাদা কাপড়ে কালিমা লেখা পতাকাও ছিল। এসব মিছিলের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নানা সমালোচনা সৃষ্টি হয়।
ইসলামের মহানবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে আয়োজন করা এসব মিছিল থেকে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতেও স্লোগান দেওয়া হয়। শুক্রবার কিশোরগঞ্জে এমনই একটি মিছিলের ভিডিও বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্ট চেক এডিটর কদরুদ্দিন শিশির ওই ভিডিওর তথ্য যাচাইয়ে পর ফেসবুকে পোস্টে জানান, ওই মিছিলে কথিত ইসলামিক স্টেট বা আইসিসের পতাকা ওড়ানো হয়েছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কদরুদ্দিন শিশির বেনারকে বলেন, “কালো পতাকা নিয়ে মিছিলের বেশ কিছু ভিডিও আমাদের নজরে এসেছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের মিছিলে কালিমা লেখা পতাকাটির ফন্ট আইসিসের লেখার সাথে মেলে।”
“এছাড়া ঢাকার মিছিলগুলোতে ব্যবহার করা কালিমা লেখা কালো পতাকাগুলোর সাথে জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদার পতাকারও মিল রয়েছে। সেটাকে আল কায়েদার পতাকা বলতেও পারেন, নাও পারেন। তবে কিশোরগঞ্জের মিছিলে ব্যবহৃত পতাকাটি আইসিসের-সেটা নিশ্চিত,” বলেন তিনি।
শনিবার দুপুরে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেও ঢাকার রামপুরা এলাকায় একই ধরনের মিছিল দেখার কথা বেনারকে জানান স্থানীয় বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেন।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সামনে কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করে হিযবুত তাহরীর।
এ বিষয়ে শাফকাত মুনীর বলেন, “এই পতাকা নিয়ে জনমনে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে। তবে এটা পরিষ্কার নয়-পতাকাটি কারা এনেছে, কী উদ্দেশ্যে এনেছে। কোনো নিষিদ্ধ সংগঠনকে যদি প্রকাশ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেওয়া হয়, তখন তা কখনোই পজিটিভ রেজাল্ট বয়ে আনবে না।”
তিনি বলেন, “জঙ্গিবাদ, সহিংস উগ্রবাদের যে হুমকি তা বাংলাদেশ থেকে চলে যায়নি।”
কালিমা লেখা কালো পতাকা মিছিলের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বেনারকে বলেন, “এর সাথে কথিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
এসব মিছিলে আইসিস বা আল কায়েদার পতাকার ব্যবহার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এটা শুনেছি। এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান হলো কোনো ধরনের উগ্রবাদ ও উস্কানি যারা দিচ্ছে তাদের অপতৎপরতা আমরা চলতে দেব না।”
মিছিল-সমাবেশকে অবশ্য নাগরিক স্বাধীনতা হিসেবে দেখেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ময়নুল ইসলাম। সোমবার রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শনকালে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “প্রত্যেকের নাগরিক স্বাধীনতা বা সমাবেশ করার স্বাধীনতা এই বাংলাদেশে দেখতে চাই। তাই বলে কেউ জঙ্গি তৎপরতা করবে; আইসিসের ভাবাদর্শে চলবে-সেটার সুযোগ নেই।”
পুলিশ প্রধান বলেন, “ইতিমধ্যে হিযবুত তাহরীরের মিডিয়া সমন্বয়ককে গ্রেপ্তারসহ কালো পতাকা নিয়ে ঝটিকা মিছিল করা তিনজনকে আটক করা হয়েছে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে।”

সরকার পতনের পরই প্রকাশ্যে হিযবুত তাহরীর
বিবিসি বাংলার ১৩ সেপ্টেম্বরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুদিন পর ৭ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানবন্ধন ও সমাবেশ করে আলোচনায় আসে হিযবুত তাহ্রীর।
সেখানে সাদাকালো কাপড়ে কালিমা লেখা পতাকা, খিলাফতের দাবি সম্বলিত ব্যানার লিফলেট নিয়ে সংগঠনটির শ’খানেক কর্মী উপস্থিত ছিলেন। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনেও সমাবেশ করে হিযবুত তাহরীরের কর্মীরা।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সভা-সমাবেশ ও মিছিল করেছে সংগঠনটি। ঢাকা শহরের বিভিন্নস্থানে পোস্টার টানানো হয়েছে নিষিদ্ধ এই সংগঠনটির নামে। বিভিন্ন জায়গায় স্টল দিয়ে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আগস্টে বন্যার সময় ‘ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদ’ জানায় সংগঠনটি।
৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানায় হিযবুত তাহ্রীর। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আবেদন করেছে তারা। ৫ আগস্ট সরকার পতনে ভূমিকা রাখার কথাও মনে করিয়ে দেন তারা।
কিন্তু গত ২৮ সেপ্টেম্বর হিযবুত তাহরীরকে ‘জঙ্গি’ সংগঠন উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক মো. ময়নুল ইসলাম।
এর এক সপ্তাহের মধ্যে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে হিযবুত তাহ্রীরের মিডিয়া সমন্বয়ক ইমতিয়াজ সেলিমকে (৪২) গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এ বিষয়ে শাফকাত মুনীর বেনারকে বলেন, “এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে আমার মনে হয়, নিষিদ্ধ প্রত্যেকটা সংগঠনের গতিবিধি মূল্যায়ন করা উচিত। তাদের চিন্তাভাবনা, কার্যক্রম বিষয়ে সরকারের শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।”
ডিএমপির উপকমিশনার তালেবুর রহমান বলেন, “হিযবুত তাহরীরের মিডিয়া সমন্বয়ককে গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে, এ ধরনের সংগঠনের প্রকাশ্যে তৎপরতা চালানোর সুযোগ নেই।”
হিযবুত তাহরীর যা বলছে
হিযবুত তাহরীরের মিডিয়া সমন্বয়ক ইমতিয়াজ সেলিম গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় বেনার প্রতিবেদকের। সংগঠনটির নেতৃত্ব, সাংগঠনিক কাঠামো, শাসন ব্যবস্থা, গণঅভ্যুত্থানে ভূমিকা, নারী স্বাধীনতার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গিসহ নানা ইস্যুতে তার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ১২টি প্রশ্ন লিখিতভাবে পাঠানো হয়।
পরে এসব প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ার বিষয়ে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের কথা বেনারকে জানান ইমতিয়াজ সেলিম।
তবে সম্প্রতিকালে নিষেধাজ্ঞার দাবি তুলে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে করা আবেদনের কপিসহ বেশ কিছু তথ্য তিনি শেয়ার করেন।
এতে হিযবুত তাহরীরকে ‘নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল’ হিসেবে দাবি করা হয়।
উল্লেখ্য, আদর্শগতভাবে বিশ্বজুড়ে 'ইসলামি খিলাফত' প্রতিষ্ঠা করা হিযবুত তাহ্রীরের লক্ষ্য। গণতন্ত্রবিরোধী এই সংগঠন কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে সংবিধান চায়। এ ধরনের একটি খসড়া সংবিধানও সংগঠনটির রয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের কয়েকটি আরব দেশ, জার্মানি, তুরস্ক, পাকিস্তানে হিযবুত তাহ্রীর নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যে তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী কাউন্টার টেররিজম এক্সচেঞ্জে (সিটিএক্স) ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আইএস ও হিযবুত তাহরীরের মধ্যে মতাদর্শগতভাবে বিশেষ তফাৎ নেই। যারা আইএসকে সমর্থন করেন, তারা হিযবুত তাহরীরকেও সমর্থন করেন। তবে আইএসের সঙ্গে তাদের কৌশলগত পার্থক্য রয়েছে।