নিরাপদ কর্মপরিবেশ: পোশাক খাতের বাইরে ৪০ হাজার কারখানা পরিদর্শন করবে সরকার

আহম্মদ ফয়েজ
2021.09.27
ঢাকা
নিরাপদ কর্মপরিবেশ: পোশাক খাতের বাইরে ৪০ হাজার কারখানা পরিদর্শন করবে সরকার নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে লাগা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন দমকল কর্মীরা। এই আগুনে অন্তত ৫০ জনের প্রাণহানি হয়। ৯ জুলাই ২০২১।
[সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

পোশাক খাতের বাইরের কল-কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্নি-দুর্ঘটনাসহ কর্মপরিবেশ সম্পর্কে জানতে দেশব্যাপী প্রায় চল্লিশ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। 

গত ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুন লেগে ৫০ জনের বেশি শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনায় কারখানাগুলোতে দুর্বল নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এরই প্রেক্ষিতে পরিদর্শনের এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। 

এ উপলক্ষে গত ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে কল-কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বে ২৪ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয় বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মোঃ সিরাজুল ইসলাম।

“এই কমিটির অধীনে বেশ কয়েকটি উপ-কমিটিও করা হয়েছে যার একটির নেতৃত্বে রয়েছেন বিডার নির্বাহী সদস্য অভিজিৎ চৌধুরী। এই কমিটির কাজ হবে সারা দেশের কল-কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে মূল কমিটির নিকট প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন পেশ করা,” বলেন সিরাজুল।

এদিকে আগামী অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হবে পরিদর্শনের কাজ শুরু হবে বলে বেনারকে জানান অভিজিৎ চৌধুরী। 

পরিদর্শন হবে ধাপে ধাপে

দেশে তৈরি পোশাক খাতের বাইরে কল-করাখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার বলে জানান বিডার চেয়ারম্যান সিরাজুল।

“এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সবকটিতে পরিদর্শন নেই, এমনকি সম্ভবও নয়,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা কয়েকটি ধাপে এই পরিদর্শন কাজ শেষ করব। প্রথম ধাপে প্রায় পাঁচ হাজার শিল্পকারখানা পরিদর্শনের আওতায় আসবে।”

তিনি জানান, ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তর, পরিদপ্তর ও জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ের যেসব ব্যক্তিদের এই নিরীক্ষা দলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে তাদেরকে অবগত করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোকদের পরিদর্শন সংক্রান্ত দিক নির্দেশনা প্রদান করার কাজ চলছে।

তিনি আরো জানান, কারখানা পরিদর্শনের জন্য মোট ৩৮টি দল গঠন করা হবে যেগুলোর প্রতিটিতেই ১০ থেকে ১২ জন সদস্য থাকবেন। এই দলগুলোর মধ্যে ঢাকায় ১৫টি, চট্টগ্রামে ১১টি, নারায়ণগঞ্জে নয়টি ও গাজীপুরে কাজ করবে তিনটি দল।

“ইতোমধ্যে শিল্প কারখানার ধরন অনুযায়ী কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নির্দেশাবলীসহ বেশ কিছু নিয়মাবলীর আলোকে একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়েছে,” বলেন সিরাজুল। 

তিনি বলেন, পরিদর্শন কাজে বিদ্যুৎ, গ্যাস, গণপূর্ত, স্থাপত্য ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের একজন করে সদস্য থাকবেন এবং প্রথম পাঁচ হাজার কারখানা তিন মাসের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামবে বিডা।

“কারখানাগুলোতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে কোনো ছোট-খাটো কারখানাকে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার থাকলে সেটিও বিবেচনা করবে সরকার,” বলেন বিডা চেয়ারম্যান।

বিদ্যমান লোকবল দিয়েই পরিদর্শনের কাজ শুরু হবে, তবে পরবর্তীতে এই কাজে বাড়তি লোকবল বা অর্থের প্রয়োজন পড়লে চাহিদা অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হবে, জানান তিনি। 

কল-কারখানা পরিদর্শনের এই তালিকায় তৈরি পোশাক খাতকে বাইরে রাখার বিষয়ে বিডা চেয়ারম্যান বলেন, “সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে এবং অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের মাধ্যমে এই খাতটিতে প্রচুর সংস্কার কাজ করা হয়েছে। এর বাইরে বর্তমানে আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি) তৎপর রয়েছে। তাই এই খাতটিকে নতুন পরিদর্শনের প্রক্রিয়ার বাহিরে রাখা হয়েছে।”

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় সহস্রাধিক শ্রমিক মৃত্যুর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশের খুচরা ক্রেতা, মানবাধিকার কর্মী ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপের মুখে বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কাজের পরিবেশ উন্নয়নে ইউরোপীয় ক্রেতারা গড়ে তোলেন অ্যাকর্ড।

একইভাবে উত্তর আমেরিকান পোশাক ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি বা সংক্ষেপে অ্যালায়েন্স গঠিত হয়। 

বাংলাদেশে নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে কাজ করে শ্রমিকদের কাছে বেশ প্রশংসিত হওয়া অ্যাকর্ড ২০২০ সালের ১ জুন শ্রমিক ইউনিয়ন-ব্র্যান্ড-শিল্প সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত আরএসসি’র কাছে বাংলাদেশ অ্যাকর্ড অফিসের কার্যক্রম হস্তান্তর করে গেলেও নেদারল্যান্ডস থেকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে। 

প্রাণহানির পরই কেন উদ্যোগ!

কল-কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ম পরিবেশ পরিদর্শনের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর প্রেক্ষিতে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করায় হতাশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

“উদ্যোগটিকে স্বাগত জানাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো প্রাণহানির আগেই কেন এমন উদ্যোগ নেওয়া গেলো না। রানা প্লাজার ঘটনায় হাজারের অধিক, হাশেম ফুড ফ্যাক্টরির ঘটনায় অর্ধশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর পর কেন এমন উদ্যোগ নেয়া হলো?” প্রশ্ন তোলেন শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

তিনি বেনারকে বলেন, “নতুন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ঠিক আছে। কিন্তু যেসব কর্তৃপক্ষের অবহেলায় অতীতের ঘটনাগুলো ঘটেছে তাদের তো শাস্তি হওয়ার কথা। সে বিষয়ে উদ্যোগ কোথায়? আজ পর্যন্ত কোনো কারখানা পরিদর্শকের তো সাজা হতে দেখা যায়নি, সেটা কেন?” 

এদিকে, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের (বিজিআইডব্লিউএফ) নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তারের মতে, বড়ো হতাহতের ঘটনা ঘটলেই এই ধরনের উদ্যোগ নেয়ার মানেই হচ্ছে বর্তমানে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয়েছে।

“বিগত বছরগুলোতে শ্রমিক হতাহতের ঘটনা পোশাক খাতের বাইরের কারখানাগুলোতেই বেশি হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় থাকায় পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা কিছুটা নিরাপত্তা পাচ্ছে,” বেনারকে বলেন কল্পনা।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য মতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১৭০ জন কর্মী যাদের মধ্যে একজন পোশাক কারখানার কর্মী এবং অন্যরা সবাই পোশাক খাতের বাইরের কারখানায় বা শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।