একের পর এক অগ্নিকাণ্ড: সরকার ও বিরোধীদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.04.17
ঢাকা
একের পর এক অগ্নিকাণ্ড: সরকার ও বিরোধীদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকার আগুন নেভাতে মই বেয়ে উঠছেন এক দমকলকর্মী। ১৫ এপ্রিল ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা যেন থামছেই না। সোমবার দেশের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে পাঁচটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

গত ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারে, ১৩ এপ্রিল নবাবপুরে একটি গোডাউন ও ১৫ এপ্রিল ঢাকার নিউ সুপার মার্কেটে বড়ো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে ছোট-বড়ো মিলে অন্তত এক ডজন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

প্রাণহানি না হলেও ঈদের আগে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

তবে এসব অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা নাকি এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে সেই প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, নির্বাচনের বছরে বিরোধী দল চক্রান্ত করে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটাচ্ছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সোমবার সাংবাদিকদের জানান, সব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করছে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি সরকারি কমিটি।

তিনি আরও জানান, তদন্তে প্রাথমিকভাবে বেরিয়ে এসেছে এসব ঘটনায় একটি বিশেষ দলের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সোমবার ঢাকায় এক বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিয়ে সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিতে আওয়ামী লীগ আগুন লাগাচ্ছে।

সোমবার যেসব জায়গায় আগুন

সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টর এলাকায় বিজিবি মোটরপার্টসের মার্কেটে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় অর্ধশত দোকান।

দুপুর ৩টার দিকে রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের স্বর্ণের মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে খুব তাড়াতাড়ি ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়।

ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, সন্ধ্যায় ঢাকার তেজগাঁ এলাকায় আগুন লেগেছে। তাঁদের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন।

ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ জেলার তারাবো পৌরসভার মৈকুলী এলাকায় দুপুরে ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেড স্যালাইন কারখানায় আগুন লাগে।

দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভাগীয় শহর রংপুরের জাহাজ কোম্পানির মোড়ে মতি প্লাজায় দুপুর সোয়া ৩টার দিকে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের চেষ্টায় দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

ষড়যন্ত্র দেখছে আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “গত এক সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটে একই সময়ে অর্থাৎ ভোরের দিকে আগুন লেগেছে। বিষয়টি নিছক দুর্ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না।”

তিনি আরও বলেন, “দেশে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাটের গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছিল। নির্বাচনের বছর এটি। নির্বাচনকে সামনে রেখে আবার কোনো গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে কি না সেটি দেখা দরকার।”

ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের প্রসঙ্গে সোমবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের জানান, এগুলো নাশকতা কি না, তা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে তাঁর মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত নয় সদস্যের ওই তদন্ত কমিটি শিগগির প্রতিবেদন জমা দেবে।

আসাদুজ্জামান খান বলেন, “তদন্তে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের লোকদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।”

তবে তিনি ওই রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ করেননি।

বিএনপির পাল্টা অভিযোগ

সারের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সোমবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কৃষক দল আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “কিছু হলেই বিএনপি; উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। ব্যবসায়ীরা নিজেরাই বলে দিলো, আমরা নিজের চোখে দেখেছি সকাল সাড়ে ৫টার সময় সিটি করপোরেশনের পোশাক পরে কয়েকজন লোক এসেছে ফুট ওভারব্রিজ ভেঙে দেওয়ার জন্য। তারা ড্রিল দিয়ে লোহা কেটে দিচ্ছিল। তারা যখন ড্রিলের তার লাগাতে গিয়েছিল সেখানে শর্ট সার্কিট হয়েছে। তারা নিজেরা দেখেছে, বলেছে। তারা আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছে। আগুন নেভাতে যখন পারেনি তখন ওই লোকগুলো পালিয়ে গেছে। এটা আমার কথা নয়, ওখানকার ব্যবসায়ীদের কথা।”

“এই আগুন লাগার পেছনে আপনারা আছেন। আপনারাই ডাইভার্ট করার জন্য; এই যে মানুষের দাবি উঠেছে সারের দাম কমাও, চালের দাম কমাতে হবে, আমাদের বাঁচতে দিতে হবে, ভালো নির্বাচন করতে দিতে হবে, ভোটের অধিকার দিতে হবে—এই দাবিগুলো পাশ কাটানোর জন্য, মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নেওয়ার জন্য আপনারা আগুন লাগিয়ে যাচ্ছেন,” বলেন বিএনপি মহাসচিব।

ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও স্বল্প আয়ের মানুষ

বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটসহ বিভিন্নস্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কে দায়ী সেই বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও এই ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মূলত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও স্বল্প আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন; সোমবার বেনারের সঙ্গে আলাপকালে এমন মন্তব্য করেন ঢাকার একটি সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আজম খান।

তিনি বলেন, “বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগার ফলে সেখানকার নিয়মিত ক্রেতারা এখন রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমলে যেতে বাধ্য হবেন। বঙ্গবাজারে একটি জিন্স প্যান্টের দাম ৬০০ টাকা হলে শপিংমলে একই মানের প্যান্টের দাম হবে কমপক্ষে দুই হাজার। ফলে দেখা যাবে, অনেক স্বল্প আয়ের মানুষ হয়তো তাঁর সন্তান-স্ত্রীকে ঈদে নতুন কাপড় দিতে পারবেন না।”

ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট মীর নাসির হোসেন বেনারকে বলেন, “গত দুই মাস ধরে যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে সেগুলো দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা সেটি আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এর জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন।”

“তবে ওইসব মার্কেটে আগুন লাগার কিছু যৌক্তিক কারণও আছে। মার্কেটগুলোর ডিজাইন খুব ভালোভাবে করা হয়নি। সেখানে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। আবার রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষও মার্কেটগুলোকে সুরক্ষিত করতে ব্যবসায়ীদের বাধ্য করেনি। এর ফলাফল হলো অগ্নিকাণ্ড,” বলেন তিনি।

মীর নাসির বলেন, “অগ্নিকাণ্ডগুলো ব্যবসায়ীদের মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে। ওই সব মার্কেটে যেসব ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন তাঁদের মূল বিক্রি হয় দুই ঈদ, পহেলা বৈশাখ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আগে। ঈদের আগে তাঁদের দোকান পুড়ে যাওয়া ভীষণ রকমের ক্ষতি।”

তিনি বলেন, “এসব ব্যবসায়ীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা করেন। আমার হিসাবে একটি দোকানের বিপরীতে মালিকসহ কমপক্ষে ৩০ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এই ৩০ জন মানুষের সঙ্গে তাঁদের পরিবার রয়েছে। সুতরাং, এই অগ্নিকাণ্ডে তাঁরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।”

“আমি মনে করি, একটি সেফটি নেটের আওতায় একটি কর্মসূচির মাধ্যমে এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের রক্ষা করা দরকার। তবে সেটি যেন কোনোভাবেই পক্ষপাতমূলক না হয়,” যোগ করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।