বাংলাদেশে পোশাক শিল্প শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার: যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট প্রতিবেদন

জন ব্যাকটেল
2020.03.05
ওয়াশিংটন ডিসি
020305_BD_garments_US_1000.jpg সাভারে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনে পুলিশের বলপ্রয়োগ। ৯ জানুয়ারি ২০১৯।
[এপি]

সাত বছর আগে ভবন ধসে এগার শ’ পোশাক শ্রমিক প্রাণ হারালেও বাংলাদেশে কারখানা ভবনগুলো এখন আগের চেয়ে নিরাপদ, তবে ভবনের ভেতরে শ্রমিকরা নিরাপদ নন। কারখানাগুলোতে নারী শ্রমিকরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন শ্রমিক সংগঠনের সদস্যরা।

এমনই তথ্য উঠে এসেছে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের ‘রানা প্লাজা ধসের সাত বছর পরও থেকে যাওয়া গুরুতর সংকট’ (সেভেন ইয়ার্স আফটার রানা প্লাজা, সিগনিফিক্যান্ট চ্যালেঞ্জেস রিমেইন) শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে।

যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক সিনেট কমিটির একটি দলের তৈরি এই প্রতিবেদনটির ওপর বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন ডিসিতে আলোচনা করেন নিউ জার্সির ডেমোক্রেটিক সিনেটর রবার্ট মেনেডেজ।

“নারীরা তৈরি পোশাক খাতের মেরুদণ্ড, আর সে কারণে জাতীয় অর্থনীতিরও মেরুদণ্ড তাঁরাই,” মন্তব্য করে মেনেডেজ বলেন, “প্রায়ই নারীরা মারাত্মক হয়রানির শিকার হন।”

প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির ২০১৯ সালের একটি জরিপের বরাত দিয়ে বলা হয়, তৈরি পোশাক কারখানায় যৌন সহিংসতার অনেক দৃষ্টান্ত আছে।

এসব দৃষ্টান্তের মধ্যে কীভাবে মেশিন চালাতে হয় দেখিয়ে দেওয়ার নামে লাইন চিফ কোনো নারীর বুকে হাত দিয়েছেন এমন অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি আছে অফিসের টেবিলের নিচে ধর্ষণ করার মতো অভিযোগও।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশে অ্যাকর্ডের যে হটলাইন আছে, সেই হটলাইনে নিয়মিত যৌন হয়রানির অভিযোগ জানিয়ে ফোন করেন ভুক্তভোগীরা।

অ্যাকর্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ক্রেতাদের একটি নজরদারিমূলক সংগঠন। ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধস ও ২০১২ সালের নভেম্বরে তাজরিন ফ্যাশনসে আগুন লেগে ১১২জন নিহত হওয়ার পর অ্যাকর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের ৩১ মে অ্যাকর্ডের মেয়াদ শেষ হবে।

প্রতিবেদনে অ্যাকর্ডকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, প্রাথমিক পরিদর্শনের সময় অ্যাকর্ডভুক্ত ৮৫ ভাগ ভবনে নিরাপত্তা ঝুঁকি শনাক্ত হয়েছিল। এরপর ১৫০টি কারখানা সব শর্ত পূরণ করে, ৮৫৭টি কারখানা ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় শর্তের ৯০ ভাগ মেনে নেয়।

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ার কারণে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৭৫টি কারখানা অ্যাকর্ডের সঙ্গে ব্যবসার অনুপযোগী বলে ঘোষিত হয়।

বাংলাদেশের প্রায় ২ হাজার তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। অ্যাকর্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পর ‘বাংলাদেশ আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল’ এই কারখানাগুলোতে নজরদারির দায়িত্ব পালন করবে।

সিনেটের এই প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে ঢাকায় শ্রম সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি প্রতিবেদনটি এখনও দেখেননি বলে জানান। তবে তিনি বলেন, কারখানার পরিবেশের অনেক উন্নতি হয়েছে।

“শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণখাতে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে এটুকু আমি বলতে পারি। দুদিন আগে আমি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করি। মার্কিন একটি দল শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতিতে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন,” বেনারকে বলেন শ্রম সচিব কে এম আলী আজম।

শ্রমিক হয়রানি

প্রতিবেদনে বলা হয়, রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনার পর শতশত ইউনিয়ন নিবন্ধিত হয়। কিন্তু শ্রমিক স্বার্থ সংস্কারের যে উদ্যোগ, তাতে ভাটা পড়ে। সংগঠকরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়েন। কারখানা মালিকরা ভয়-ভীতি দেখাতে শুরু করেন। কিন্তু এই মালিকদের কাউকেই বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ লঙ্ঘন করার দায়ে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা হয়নি।

“২০১৮ সালের ডিসেম্বর ও ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের ওপর সহিংসতা ও নির্যাতন এই নিম্নমুখী প্রবণতার প্রমাণ,” বলা হয় প্রতিবেদনে।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে পুলিশ আন্দোলনকারীদের দমাতে জল কামান, লাঠি ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনটিতে।

প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শ্রমিকের উল্লেখ আছে। ওই শ্রমিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাথে ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি ঠিক কী ঘটেছে সে সম্পর্কে কথা বলেছেন। তিনি জানান, সেদিন এক সহকর্মী সুমন মিয়ার সঙ্গে তিনি দুপুরের খাবার খেয়ে কারখানায় যাওয়ার পথে আন্দোলনে আটকা পড়ে যান।

“পুলিশ গুলি ছুড়তে শুরু করল, শ্রমিকরাও দৌড়ে পালাতে লাগল। সুমন ও আমিও দৌড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ সুমনের বুকে গুলি লাগে এবং সে পড়ে যায়। আমি পালিয়ে যাই। পরে আমি সুমনের মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখি। পুলিশ এমনকি ওর মৃতদেহটাও সরায়নি,” বলেন ওই শ্রমিক।

এর দুই বছর আগে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সে সময় সরকার ও মালিকপক্ষ মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চলা ‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলন’ কঠোরভাবে প্রতিরোধ করে।

“কমপক্ষে ১৫শ কর্মীর চাকরি চলে যায়, ৩৮ জন ইউনিয়ন নেতাকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়, ট্রেড ইউনিয়ন অফিসগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সরকার তীব্র চাপ প্রয়োগ করে,” বলা হয় প্রতিবেদনে।

ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যখন পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সম্মেলন বর্জন করে, তখনই সরকার গ্রেপ্তারকৃতদের ছাড়তে শুরু করে।

তবে শ্রম সচিব আলী আজম বেনারকে জানান, ইউনিয়ন গঠনে যে শর্তগুলো ছিল, সরকার সেই শর্তের সংখ্যা কমিয়ে এনেছে। যেমন, ইউনিয়ন গঠনে আগে ৩০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন লাগত, এখন ২০ শতাংশ হলেই সংগঠনের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।

“মার্কিন সরকার দাবি জানিয়েছে এই পরিমাণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে, আমরা এই প্রস্তাব বিবেচনা করছি,” বলেন শ্রম সচিব।

“আমাদের অগ্রগতি অসাধারণ,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিশ্বের ১০টি পরিবেশবান্ধব কারখানার সাতটিই এখন বাংলাদেশে।”

“কিন্তু এতেও আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না। আমরা শ্রমিক অধিকার ও মানের উন্নতিতে আরও কাজ করব,” যোগ করেন তিনি।

তবে বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফয়সাল সামাদ হয়রানি ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অভিযোগ সম্পর্কে বেনারকে বলেন, “এটি প্রকৃত চিত্র নয়।”

“রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার পর আমরা কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সর্বোপরি বিশ্বে যেন আমাদের কারখানাই সেরা হয় সেজন্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছি। আমি এতটুকু জোর গলায় বলতে পারি, সব ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি আছে,” বলেন ফয়সাল সামাদ।

প্রতিবেদনটি খতিয়ে দেখে তাঁরা ঠিক বলছেন কি না খুঁজে দেখতে শ্রমিক, মার্কিন দূতাবাস, সরকার ও বিজিএমইএর সদস্য নিয়ে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন সামাদ।

এদিকে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের উপপ্রধান মাহবুব সালেহ ওই প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় উপস্থিত ছিলেন।

তিনি প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন, “আপনারা জেনে খুশি হবেন, সিনেটর মেনেডেজ, বাংলাদেশে এখন তৈরি পোশাক শিল্প খাতে আট হাজারের ওপর ইউনিয়ন আছে। ২০১৫ সালে যেখানে ইউনিয়ন গঠনের আবেদন প্রত্যাখ্যানের পরিমাণ ছিল ৭৩ শতাংশ, এখন সেটা ৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে।”

প্রতিবেদনটির প্রশংসা করে কারখানাগুলোর মান উন্নয়নের বিষয়টি একটি ‘অব্যাহত প্রচেষ্টা’ বলে মন্তব্য করেন মাহবুব সালেহ।

জবাবে মেনেডেজ বলেন, তিনি ও তাঁর কমিটির কর্মীরা শ্রমিকদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

যখন সাসটেইনেবেলিটি কাউন্সিল নজরদারির দায়িত্ব গ্রহণ করবে, তখন নিরাপদ ভবনে শ্রমকিদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের ওপর এসে পড়বে বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে।

“কেবলমাত্র তখনই ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ একটি নমুনা হিসেবে গণ্য হবে, সব মানুষের মধ্যে অহংকার করার মতো পর্যায়ে পৌঁছাবে তখনই,” বলা হয় প্রতিবেদনের সমাপনী মন্তব্যে।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।