করোনাভাইরাস: রপ্তানীমুখী শিল্পে ইউরোপীয় দেশগুলোর হাজার কোটি টাকার অনুদান ঘোষণা

প্রাপ্তি রহমান
2020.12.11
ঢাকা
করোনাভাইরাস: রপ্তানীমুখী শিল্পে ইউরোপীয় দেশগুলোর হাজার কোটি টাকার অনুদান ঘোষণা ঢাকার মিরপুর এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকরা। ৭ মে ২০২০।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শ্রমিকরা চান, ইউরোপীয় দেশগুলোর ঘোষিত এক হাজার কোটি টাকার বেশি অনুদান যেন করোনাভাইরাস মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের হাতে সরাসরি দেওয়া হয়।

এদিকে এই অনুদান বিতরণের নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। পোশাক মালিকরা শুরু করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের তালিকা প্রণয়নের কাজ। 

বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জার্মানি করোনাভাইরাস মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি রপ্তানীমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিকদের জন্য ১১ কোটি ৩০ লাখ ইউরো (প্রায় ১,১৬০ কোটি টাকা) অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেয়।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনস টিরিঙ্ক বলেন, এই অর্থ কর্মহীন ও বিপন্ন মানুষের জন্য। 

বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রপ্তানীমুখী প্রতিষ্ঠানের ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকেরা এই অর্থ সহায়তা পাবেন বলে জানান রেনস টিরিঙ্ক। তাঁর মতে, “এই কর্মসূচি বেকার ও বিপন্ন মানুষের জীবিকার সুরক্ষা দেবে।” 

গত এপ্রিল থেকে বেকার আছেন আশরাফুল ইসলাম (২৭) নামে এক গার্মেন্টস কর্মী, কাজ করতেন সাভার ইপিজেড এলাকার একটি পোশাক কারখানায়। তাঁর স্ত্রীও সাভারে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন, তিনিও করোনার শুরু থেকে বেকার। কাজ চলে যাওয়ার পর এই দম্পতি তাঁদের একমাত্র মেয়েকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার কথা জানান। 

“অনুদান আসার খবর আমরা শুনেছি। কিন্তু পাব কিনা, কীভাবে পাব তা এখন পর্যন্ত জানি না,” বলেন আশরাফ। 

এই শ্রমিক দম্পতির বাড়ি ঠাকুরগাঁও জেলায়, থাকেন সাভারে। কাজ হারানোর পর চাকরি খুঁজছেন। 

“করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার পর সৃষ্টি হওয়া পরিস্থিতিতে নতুন করে নিয়োগ বন্ধ বলে জানিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তবু আমরা কাজ খুঁজছি। এর মধ্যে কিছু অনুদান পেলে তা খুবই সহায়ক হবে। আর সেটি আমাদের কাছে সরাসরি আসলেই ভালো,” জানান আশরাফ। 

ক্রয়াদেশের গতি শ্লথ

বাংলাদেশে উৎপাদিত তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ওই দেশগুলোর খ্যাতনামা ব্রাণ্ডগুলো গার্মেন্টস পণ্য কেনাবেচা বন্ধ করে দেয়। ফলে বিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়, ক্ষেত্রবিশেষ স্থগিত হয়ে যায়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ওপর।  

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ নিট ওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) চলতি বছরের এপ্রিলে প্রায় ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিলের কথা জানায়।

গত জুলাই পর্যন্ত ক্রেতা দেশগুলো তাদের ক্রয় আ​দেশ স্থগিত রাখে। এরপর যখন প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখনই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নতুন শঙ্কার সৃষ্টি করে।

বিজিএমইএর হিসেবে, মহামারির কারণে প্রথম দফায় ৭০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন। বিশ্বজুড়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর গত ৭ ডিসেম্বর বিজিএমই প্রেসিডেন্ট রুবানা হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ক্রয়াদেশের গতি শ্লথ হয়ে এসেছে। 

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এ বছরের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত তৈরি পোশাকের রপ্তানী কমেছে ৩৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে রপ্তানিতে সামান্য প্রবৃদ্ধি হলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে আবারও তা হুমকির মুখে পড়েছে,” বলেন রুবানা হক। 

আবারও প্রণোদনা প্রয়োজন—এ কথা জানিয়ে​ বিজিএম​ইএ সভাপতি বলেন, প্রথম দফায় সামান্য সুদে তৈরি পোশাক খাতে সরকার ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়, যার বড় অংশ শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধে ব্যয় হয়েছে।  

সরকারি হিসেবে, বাংলাদেশের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের বড় অংশই নারী। জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হলো এই তৈরি পোশাক খাত। অনুদানের এ​ই টাকা তৈরি পোশাক ছাড়াও জুতা ও চামড়া রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকেরা পাবেন। 

তিন মাস পর্যন্ত অনুদান পাবেন শ্রমিকরা

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতে জার্মানি ও ইইউ মিয়ানমারের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য জরুরি অর্থ সহায়তা দেয়। ওই সময় বাংলাদেশের জন্যও তারা ১১ কোটি ৩০ লাখ ইউরো অনুদানের ঘোষণা দিয়েছিল, আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হলো বৃহস্পতিবার। 

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশের নতুন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় তৈরি পোশাক, চামড়া ও জুতো শিল্পে সম্পৃক্ত শ্রমিকরা প্রাথমিক পর্যায়ে মাসিক তিন হাজার টাকা করে তিন মাস পর্যন্ত অনুদান পাবেন।

এই অর্থ পাবেন করোনাভাইরাসের কারণে ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন কিংবা বেতন কমে গেছে এমন শ্রমিকেরা। 

শ্রম অধিদপ্তরের মহারিচালক মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, অনুদানের টাকা কারা পাবেন সে বিষয়ে সরকার একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। সেই শর্তপূরণ সাপেক্ষে টাকাটা বণ্টন হবে। এই অনুদানের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকেও আরো টাকা দেওয়া হবে।  

তিনি বলেন, “আমরা কাজ হারানো শ্রমিকদের পাশে থাকতে চাই। বিদেশি সাহায্যের সঙ্গে সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে ৪০০ কোটি টাকার অনুদান ঘোষণা করেছে।

শ্রমিকদের তালিকা হাতে পেলেই কত শ্রমিক এই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আসবেন সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে বলে জানান তিনি।

এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের “তালিকা তৈরির কাজ চলছে,” জানিয়ে বিজিএমই এর সহসভাপতি মশিউল আলম বেনারকে বলেন, আশা করছি চলতি মাসের ২০ তারিখের মধ্যে তালিকা চূড়ান্ত হবে।” 

একইভাবে অন্যান্য খাতের মালিকসংগঠনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের তালিকা অনুমোদনের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে বলে জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। 

তবে তালিকা চূড়ান্ত না হওয়ায় কবে নাগাদ শ্রমিকার এই অর্থ পাবেন তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বেনারকে বলেন, সরকার ও মালিক সংগঠনগুলো যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে না, অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে।

তিনি বলেন, “করোনার শুরুতে মালিকপক্ষকে সরকার বড়ো অঙ্কের অনুদান দিলো। তারপরও তারা শ্রমিকদের পুরো মজুরি পরিশোধ করেনি। আমরা চাই এবারের অনুদান সরাসরি শ্রমিকদের হিসেবে পৌঁছে দেওয়া হোক।

“প্রত্যেক শ্রমিকের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, মালিক সংগঠনগুলোর হস্তক্ষেপ ছাড়াও এই অর্থ তাঁদের কাছে সরাসরি পৌঁছানো সম্ভব,” মনে করেন জলি তালুকদার। 

গত বছর ডিসেম্বরে চীনে প্রথম ধরা পড়লেও বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হয় চলতি বছরের ৮ মার্চ। এর দশ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো এই রোগে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। 

জুন-জুলাই মাসে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হন, ৪০ জনের বেশি মারা যান। সেপ্টেম্বরের দিকে বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃতের হার কমে আসলেও শীত শুরুর সাথে সাথে নভেম্বর থেকে আক্রান্ত ও মৃতের হার আবার বাড়তে শুরু করেছে।  

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন চার লাখ ৮৭ হাজার ৮৪৯ জন, মৃত্যু হয়েছে ছয় হাজার ৯৮৬ জনের। 

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ছয় কোটি ৯৮ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ১৫ লাখ ৮৭ হাজারের বেশি। 

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।