বিমান ছিনতাই চেষ্টাকারী শনাক্ত, পিস্তলের আসল-নকল বিতর্ক
2019.02.25
ঢাকা
চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে সেনাবাহিনীর ‘কমান্ডো’ অভিযানে নিহতের আসল নাম পলাশ আহমেদ। বাংলাদেশ বিমানের দুবাইগামী উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টাকারী এ যুবকের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নে।
দুধঘাটা গ্রামের পিয়ার জাহান সরদারের ছেলে সে। অনুসন্ধানে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) তথ্যভাণ্ডারে তার আঙুলের ছাপ ও পরিচয় মিলেছে। সংস্থার আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান সোমবার দুপরে বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
র্যাব জানায়, ১৭ বছরের এক কিশোরীকে অপহরণের পর আট লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির অভিযোগে ২০১২ সালের ২৮ মার্চ পলাশকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব-১১। তার পরিবারের সাথে রবিবার রাতেই যোগাযোগ করে সোনারগাঁও থানা-পুলিশ।
তারা পলাশের বাবাকে ছবি দেখিয়ে তার পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে জানিয়ে সোনারগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “পলাশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, বাড়িতে খুব বেশি থাকত না। যে কারণে এলাকার মানুষও তার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানে না।”
পলাশের পরিবার পুলিশকে জানায়, ২০১১ সালের দিকে স্থানীয় তাহিরপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে সে সোনারগাঁও ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও পড়াশোনা শেষ করেনি, উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করত।
“সাধারণত শুধু টাকার প্রয়োজন হলেই সে বাড়িতে আসত। তবে গত পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে বাড়িতেই ছিল। এ সময় নিয়মিত মসজিদে যাওয়া-আসা করত,” বেনারকে বলেন পলাশের বাবা। দুবাই যাওয়ার কথা বলে শুক্রবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সে।
বিমানের যাত্রীর তালিকা অনুযায়ী পলাশ অভ্যন্তরীণ রুটের (ঢাকা-চট্টগ্রাম) যাত্রী ছিল। তার নাম উল্লেখ ছিল, ‘আহমেদ এমডি পলাশ,’ আসন নম্বর ছিল ‘১৭এ’।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী সোমবার বেনারকে বলেন, “তদন্ত শেষ হওয়ার আগে বলা যাচ্ছে না যে কী তাকে এমন ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত করেছে।”
রোববারের ছিনতাইকাণ্ডের ঘটনায় সোমবার চট্টগ্রামের পতেঙ্গা মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পরিবহন কর্তৃপক্ষ। মামলায় কোনো অস্ত্র উদ্ধার দেখানো হয়নি। বলা হয়েছে, “দুষ্কৃতকারীর হাতে বোমা ও অস্ত্রসদৃশ বস্তু দেখা গেছে।”
পাঁচ দিনে বেরোবে প্রকৃত ঘটনা
একইদিন ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে এই (ছিনতাই চেষ্টা) বিষয়ে প্রকৃত ঘটনা জানাতে পারব বলে আমরা আশা করছি।”
“বিমানবন্দরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা রয়েছে। সেই নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে ওই অস্ত্রধারী কীভাবে প্রবেশ করল- তা নিয়ে আমরা রীতিমতো হতবাক। এ বিষয়ে শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে,” বলেন তিনি।
এ সময় মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মহিবুল হক বলেন, “সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে আমরা দেখেছি, আর দশজন যাত্রীর যেভাবে ‘সিকিউরিটি বডি স্ক্যান’ হয়, তারও (পলাশ) ঠিক সেভাবেই হয়েছে। আনসাররাও তাকে ‘চেক’ করেছে।”
“তার ঘাড়ে একটা ব্যাগ ছিল, সেই ব্যাগটাও ‘স্ক্যানিং মেশিনের’ ভেতর দিয়ে গেছে,” যোগ করেন সচিব।
“ওই বিমানের যাত্রীদের দুটি গন্তব্য ছিল। কিছু যাত্রী চট্টগ্রামের এবং কিছু দুবাইয়ের। যে কারণে কিছু যাত্রী আন্তর্জাতিক গেট এবং কিছু অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের মধ্য দিয়ে ঢুকেছে,” বেনারকে বলেন প্রতিমন্ত্রী।
শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত একজন কর্মকর্তা বেনারকে জানান, সেখানে বিমানে যাওয়ার আগে একজন আন্তর্জাতিক যাত্রীকে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় পেরোতে হয়, আর অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের দুই স্তরের।
সংসদীয় কমিটি গঠনের দাবি
জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্য রুস্তম আলী ফরাজি প্রশ্ন তুলেছেন, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চার স্তরের নিরাপত্তা ভেদ করে একজন যাত্রী কীভাবে অস্ত্র নিয়ে বিমানে উঠতে পেরেছেন? এ ঘটনা তদন্তে তিনি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠন করার দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ জাসদের সংসদ সদস্য মঈন উদ্দীন খান বাদল জানান, “আমি স্বচক্ষে দেখেছি, বিমানের ক্যাপ্টেন গোলাম শফি, ফার্স্ট অফিসার মুনতাসীর মাহবুব এবং পাঁচজন ক্রু কী অসম সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন।”
“এদের যথাযথভাবে পুরস্কৃত করা উচিত,” বলেন তিনি।
ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে যাত্রাবিরতি থাকা যাত্রীদের নিয়ে একটি বিকল্প উড়োজাহাজ দুপুর সোয়া একটায় ১৪৭ জন যাত্রী নিয়ে শাহ আমানত ছেড়ে গেছে।
খেলনা ও আসল পিস্তল বিতর্ক
ছিনতাইকারীর সাথে থাকা ‘অস্ত্র’ সম্পর্কে সচিব মহিবুল বলেন, “প্রকৃত বা খেলনা পিস্তল, যে কোনো কিছু হতে পারে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেলে বুঝতে পারব আসলে ওটা কী?”
এর আগে রবিবার অভিযান পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘জিওসি’ মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান বলেন, “ওই যুবকের কাছ থেকে একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।”
পরে পিস্তলটি পরীক্ষা করে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার মোহাম্মদ মাহবুবার রহমান সাংবাদিকদের জানান, সেটি খেলনা পিস্তল। এ ছাড়া বিমান প্রতিমন্ত্রী এবং র্যাবও গণমাধ্যমকে বলেছেন পিস্তলটি আসল নয়।
যাত্রীরা গুলির আওয়াজ শোনার কথা বললেও বিমানের ভেতরে গুলি হওয়ার কোনো প্রমাণও মেলেনি বলেও জানান বেসামরিক বিমান সচিব।
লাশ হিমঘরে
পলাশের লাশ রবিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায় পুলিশ। ময়নাতদন্তের পর সেটিকে হিমঘরে রাখা হয়।
লাশ নেওয়ার জন্য কেউ যোগাযোগ করেনি বলেও জানান পতেঙ্গার ওসি। এ ছাড়া সোনারগাঁওয়ের ওসি জানিয়েছেন, পলাশের পরিবার তার লাশ আনতে আগ্রহী নয়।
পলাশের বাবা বেনারকে বলেন, “আমার সন্তান একটি জঘন্য অপরাধ করেছে। আমি তার মৃতদেহ নিতে চাই না।”
আলোচনায় পলাশের স্ত্রী
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসান রবিবার বলেছিলেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পারি, স্ত্রীর সঙ্গে বিবাদের জেরে ‘সো-কলড’ ছিনতাইকারী বিমানটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন।”
পলাশের স্বজনরা জানান, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রনায়িকা সিমলা তার দ্বিতীয় স্ত্রী। এর আগে সে মেঘলা নামের এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল। তাদের আড়াই বছর বয়সী আয়ান নামের একটি সন্তানও আছে।
নিহত পলাশের ‘মাহাবি জাহান’ নামের একটি ‘ফেসবুক অ্যাকাউন্ট’ খুঁজে পাওয়া গেছে। যেখানে তিনি নিজেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ‘তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায় বিশ্লেষক’ উল্লেখ করেছেন। রবিবার দুপুরে সর্বশেষ ফেসবুক প্রকাশনায় তিনি লিখেছেন, “ঘৃণা নিশ্বাসে প্রশ্বাসে।”
পলাশ চলচ্চিত্র প্রযোজনা শুরু করেছিল বলেও জানায় তার পরিবার।