বান্দরবানে গোলাগুলিতে এক সেনা কর্মকর্তা ও তিন ‘সন্ত্রাসী’ নিহত
2022.02.03
ঢাকা

পাহাড়িদের সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) একাংশের সাথে গোলাগুলিতে সেনাবাহিনীর এক সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার (নন-কমিশন্ড) এবং তিন সশস্ত্র ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান, রুমা উপজেলার দুর্গম এলাকা বথিপাড়ায় বুধবার রাত সাড়ে ১০টার পর ওই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে।
পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইএসপিআর এবং সেনাবাহিনীর ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড ও বান্দরবান অঞ্চলের সদরদপ্তর বলেছে, “পলায়নপর সন্ত্রাসীদের এলোপাথাড়ি গুলিতে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে টহল কমান্ডার সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমান ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন এবং ফিরোজ নামে এক সেনাসদস্য ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।”
নিহত স্থানীয় তিনজনকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিতে নেতৃত্ব দেওয়া আঞ্চলিক নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন ‘জেএসএস মূল দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও তাঁদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি সেনাবাহিনী।
তবে সন্ধ্যায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটির সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা বলেন, “ওই ঘটনার সাথে জনসংহতি সমিতি বা সমিতির কোনো সদস্য জড়িত নয়। জনসংহতি সমিতির কোনো ধরনের সশস্ত্র গ্রুপ থাকার প্রশ্নই ওঠে না।”
তাঁদের বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগ “সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত” বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
“লাশ তিনটি আমরা উন্মুক্ত অবস্থায় রেখেছি। যাতে লোকজন এসে তাঁদের চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত পরিচয় যাচাইয়ের জন্য কেউ আসেনি,” সন্ধ্যায় বেনারকে বলেন পুলিশের রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কাশেম।
নিহতদের স্বজনদের জন্য শুক্রবার সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা। এই তিনজনের বয়স ২৯-৩২ বছরের মধ্যে এবং নিহত সেনা সদস্যের বয়স কমপক্ষে ৫৪ বছর বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সেনাবাহিনী জানায়, চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যে জেএসএস সন্ত্রাসীদের আসার খবর পেয়ে রাইংখিয়াং লেক আর্মিক্যাম্প থেকে সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবের নেতৃত্বে একটি টহল দল ওই এলাকায় যায়। সন্ত্রাসীরা একটি জুম ঘর থেকে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করলে টহল দলও পাল্টা হামলায় চালায়।
“সন্তু লারমার মদদপুষ্ট জেএসএস মূল দলের তিনজন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যায়,” উল্লেখ করে তারা আরো জানায়, বর্তমানে সেনা টহল দল ওই এলাকায় ব্যাপক তল্লাশি জারি রেখেছে এবং স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
অন্যদিকে জেএসএস-সন্তু লারমার দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে নস্যাৎ করা এবং দমন-পীড়নের হীনলক্ষ্যে উদ্দেশ্য বন্দুকযুদ্ধের সাথে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের জড়িত করা হয়েছে। এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে তারা।
যদিও গত মাসে শান্তি চুক্তির দুই যুগ পূর্তির অনুষ্ঠানে সন্তু লারমা সরকারকে যে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, এই ঘটনায় তারই প্রতিফলন দেখছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘাত অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম।
চুক্তি বাস্তবায়নের ধীর গতি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে সন্তু লারমা সেদিন ফের রুখে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন জানিয়ে ড. রফিক বলেন, “এই কথার মানে পাহাড়িদের অধিকার আদায়ে চুক্তির আগের সশস্ত্র পথে ফিরে যাওয়া কি-না তা নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, সেটারই প্রতিফলন এই সংঘাতে দেখতে পাচ্ছি।”
“১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি হওয়ার পর আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরে আসবে,” উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, “শান্তিচুক্তির ব্যাঘাত দুই পক্ষই করছে। একদিকে সরকার শ্লথগতিতে এগোচ্ছে, অন্যদিকে পাহাড়িদের যারা চুক্তির পক্ষে ছিল তারাও নিজেদের জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে।”
ঢাকায় গত ২ ডিসেম্বরের ওই অনুষ্ঠানে সন্তু লারমা বলেছিলেন, “পাহাড়ের মানুষ শান্তিপ্রিয় বলে এখনো অপেক্ষা করছে, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। চুক্তি যদি বাস্তবায়ন না হয় তবে পাহাড়ের ছাত্র যুব সমাজ নিশ্চয় রুখে দাঁড়াবে।”
সেনাবাহিনীর বক্তব্য
আইএসপিআর বলেছে, “জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সেনা সদস্যবৃন্দ নিরীহ পার্বত্য জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা রক্ষায় তৎপর রয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান আঞ্চলিক দলসমূহ হত্যা, গুম, চাঁদাবাজি ইত্যাদি দুষ্কৃতিমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে পাহাড়ে নিরীহ সাধারণ মানুষের জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করছে।”
৬৯ পদাতিক ব্রিগেড ও বান্দরবান সেনা অঞ্চলের সদরদপ্তর বলেছে, “চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ‘অনুচ্ছেদ ঘ’ এর ধারা অনুযায়ী সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেওয়ার মাধ্যমে তৎকালীন শান্তিবাহিনী সকল সদস্যের আত্মসমর্পণের শর্ত থাকলেও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস তা ভঙ্গ করে চুক্তি সম্পাদনের পরবর্তী সময় থেকেই সশস্ত্র সন্ত্রাসী লালন করে আসছে। যদিও প্রায়ই সন্তু লারমা ও তার দল সরকারের বিরুদ্ধে শান্তি চুক্তির শর্ত ভঙ্গ ও বাস্তবায়ন না করার অভিযোগ করে থাকে।”
পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎপর চারটি আঞ্চলিক দল “সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ হতে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড সৃষ্টি পায়তারা করছে, যা নিঃসন্দেহে দেশদ্রোহিতার শামিল” বলেও উল্লেখ করা হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
“এ পরিস্থিতিতে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী বুকের রক্ত দিয়ে হলেও দেশের স্বাধীনতা ও ভূখণ্ডে অখণ্ডতা রক্ষা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য বদ্ধপরিকর,” উল্লেখ করা হয়েছে দুটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেই।
জানতে চাইলে জেএসএস-সন্তু লারমার নেতা দীপায়ন খীসা বেনারকে বলেন, “আমি এ ব্যাপারে বক্তব্য দেওয়ার মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তি নই।”
তবে আরেক আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মূলধারা সমর্থিত চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) সভাপতি সুনয়ন চাকমা বেনারকে বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের সক্রিয় কোনো সংগঠন ঘোষণা দেয়নি যে, তারা স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠন করতে চায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ন্যায্য স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যাতে সমতলে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারায়, সে লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অপপ্রচার চালিয়ে থাকে। তারই অংশ হচ্ছে পাহাড়িদের আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেব অপপ্রচার করে প্রশ্নবিদ্ধ করা।”
মূল কারণ স্বার্থের সংঘাত
পাহাড়িদের সাথে রাষ্ট্রের স্বার্থের সংঘাতই পার্বত্য এলাকার অস্থিতিশীলতার মূল কারণ উল্লেখ করে বিশ্লেষক ড. রফিক বলেন,“রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব সেখানে সেনাবাহিনীই বাস্তবায়ন করছে। সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে অনেক ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনকেও সেখানে সেনাপ্রশাসনকে মেনে চলতে হয়।”
“সব মিলিয়ে অস্তিত্ব সংকটে ভোগা পাহাড়িরা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে চায় বলেই সেখানে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আবার সেনাবাহিনী সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার কথা বলে নিজেদের সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়,” বলেন তিনি।
তবে সংগঠনগুলোর কাছে অস্ত্র থাকার অভিযোগ সত্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা শুধু সেনাবাহিনীই নয়, নিজেদের মধ্যেও রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়ায়। এমন বহু প্রাণহানির ঘটনা আমরা গত দুই যুগে দেখেছি।
উল্লেখ্য, পার্বত্য জেলাগুলো সেনাবাহিনীর সাথে প্রায়ই প্রাণঘাতী সংঘর্ষে জড়ায় আঞ্চলিক দলগুলো। এর আগে ২০১৯ সালের ১৮ আগস্টে রাঙ্গামাটির রাজস্থলীতে গুলিবিদ্ধ সৈনিক নাসিম (১৯) নামের এক সেনাসদস্য চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন।