বৌদ্ধরা কঠিন চীবর দান করবেন না, দুর্গাপূজায় নিরাপত্তা শঙ্কা হিন্দুদের
2024.10.07
ঢাকা

পার্বত্য তিন জেলায় কঠিন চীবর দান উৎসব উদযাপন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেখানকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা।
এদিকে ওইসব জেলার স্থানীয় প্রশাসন মঙ্গলবার থেকে তিন সপ্তাহ অন্য জেলার বাসিন্দাদের পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে।
বুধবার থেকে অনুষ্ঠিতব্য দুর্গাপূজা নির্বিঘ্নে উদযাপন নিশ্চিত করতে পূজা মণ্ডপগুলোতে সেনা সদস্য মোতায়েন করেছে সরকার, যা স্মরণকালের ইতিহাসে বিরল বলে জানিয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা।
তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনী এখনো পুরোপুরি সক্রিয় না হওয়ায় সম্ভাব্য অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে সেনা মোতায়েন করায় অনেকটা আশ্বস্ত তারা, তবে শঙ্কা কাটেনি।
গত শনিবার সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে নিরাপত্তা নিশ্চিতে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়ে নির্ভয়ে পূজা উদযাপন করার আহবান জানান। রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পরিদর্শন করে সেনাপ্রধান সাংবাদিকদের বলেন, দুর্গাপূজায় সারাদেশে পর্যাপ্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নির্ভয়ে পূজা মণ্ডপে যেতে পারবেন।
এছাড়া বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে রোববার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপনে সবার সহযোগিতা চান।

ওই সংলাপ শেষে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে পূজার নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই বিষয়ে দলগুলো সরকারকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।”
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বেনারকে বলেন, “সরকার নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। তাদের চেষ্টাও স্পষ্ট। কিন্তু পুলিশ এখনো সক্রিয় না থাকায় পূর্ণার্থীদের মধ্যে নানা রকম আস্থাহীনতা রয়েছে।”
তিনি বলেন, “অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও মণ্ডপে মণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর যেভাবে তাণ্ডব হয়েছে, তাতে এখনো অনেকেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আছেন।”
চলতি বছর এ পর্যন্ত ১৫টি জেলায় ১৯টি মন্ডপ ভাঙ্গার তথ্য উল্লেখ করে রানা দাশ বলেন, “পূজা হয়তো হবে, কিন্তু তা উৎসবমুখর পরিবেশে হবে কি না সেটা এখনো বলা মুশকিল।”
চলতি বছর দেশজুড়ে প্রায় ৩১ হাজার ৫০০ মন্ডপে পূজা উদযাপন হবে বেনারকে জানান বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা।
রোববার রমনা কালীমন্দির পরিদর্শন শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ৮ দফা নির্দেশনা প্রতিটি পূজামণ্ডপে পাঠানো হয়েছে। বিভাগীয় ও জেলা পুলিশ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের কাছেও নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
“এবার কোনো ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। পূজা এবার নির্বিঘ্নে হবে,” আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এর আগে গত ২ অক্টোবর দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল জোরদার এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোসহ মাঠ প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য আটটি নির্দেশনা জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সোমবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দুর্গাপূজার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বলেছেন, “দুর্গাপূজায় কোনো জঙ্গি হামলার শঙ্কা নেই। তবে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।”
“নিরাপত্তা শঙ্কা নেই, তবুও আমরা সতর্ক থাকতে চাই। কেউ যেন ফায়দা লুটতে না পারে সেজন্যই বাড়তি সতর্কতা,” বলেন তিনি।

কঠিন চীবর দান উদযাপন হচ্ছে না
পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে এ বছর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বৌদ্ধ মন্দিরে বার্ষিক কঠিন চীবর দান উদযাপন না করার ঘোষণা দিয়েছেন।
রোববার এক রাঙামাটি বনরূপা মৈত্রী বিহারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন করে এই ঘোষণা দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্মিলিত ভিক্ষু সংঘ।
সেখানে ভিক্ষু সংঘের সভাপতি ভদন্ত শ্রদ্ধালংকার মহাথের বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি ও নিরাপত্তাজনিত কারণে এ বছর রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কঠিন চীবর দান উৎসব উদযাপন না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্তত ১৫টি বৌদ্ধ গোষ্ঠী এই সিদ্ধান্তের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে।
উৎসবটি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তিন মাসের বর্ষাকালের উপবাস এবং উপবাসের সমাপ্তিতে তাদের পরিধেয় কাপড় দানের জন্য করা হয়ে থাকে।
নিয়ম অনুসারে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদিবাসী নারীরা জুমে উৎপাদিত তুলা থেকে চরকায় সূতা কেটে বেইনের (কোমর তাঁত) মাধ্যমে তৈরির পর সেলাই ও রঙ করে চীবর হিসেবে তৈরি করেন এই কাপড়। এই অনুষ্ঠান একমাস পর্যন্ত চলতে পারে এবং এই সময়ে ভিক্ষুরা নতুন কাপড় পান।
এ প্রসঙ্গে ভিক্ষু সংঘের সহ-সভাপতি প্রজ্ঞা জ্যোতি ভিক্ষু বেনারকে বলেন, সম্প্রতি দেখা গেছে ১৪৪ ধারা জারি থাকা অবস্থায় জাতিগত সংখ্যালঘুদের বাড়ি এবং ধর্মীয় মন্দিরে লক্ষ্যবস্তুতে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
“এ রকম নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও যখন হামলার ঘটনা ঘটে তখন আমরা কোন ভরসায় উৎসব করতে যাবো?,” প্রশ্ন রাখেন তিনি।
সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের এই জেলাগুলোতে জাতিগত সহিংসতায় চারজন আদিবাসীসহ কমপক্ষে ছয় জনের মৃত্যু ও নানা স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল আহমেদ বেনারকে বলেন, “আমরা ভিক্ষুদের সঙ্গে কথা বলছি, ওনাদের নিরাপত্তার বিষয়টি আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি, যাতে তারা অনুষ্ঠান করেন।”
চন্দ্র মাসের হিসেবে, চলতি মাসের ১৭ তারিখের পর অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা।
এদিকে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটিতে মঙ্গলবার থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত পর্যটকদের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা ঘিরে নানা সময় নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়। এসব বিবেচনায় সব পক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে।
“এটা মনে রাখতে হবে সাম্প্রদায়িক সহ অবস্থান নিশ্চিত করা না গেলে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে,” যোগ করেন তিনি।
এই বিশ্লেষকের মতে, পাহাড় হোক বা সমতল হোক সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান সম্প্রতির মাধ্যমেই নিশ্চিত করতে হবে।