নিবন্ধন নবায়ন না করায় ‘অস্তিত্ব সংকটে’ পড়বে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার
2022.06.07
ঢাকা
আবেদন করার সাত বছরের বেশি সময় পর ‘রাষ্ট্রের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ’ করার অভিযোগ তুলে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এর নিবন্ধন নবায়ন করেনি সরকারের এনজিও বিষয়ক ব্যুরো।
নিবন্ধন নবায়নের জন্য আদালতে অধিকারের দায়ের করা রিট আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংগঠনটির আইনজীবী রুহুল আমিন ভূঁইয়া।
নিবন্ধন নবায়ন না হওয়ায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অধিকার সেভাবে কাজ করতে পারবে না বলে মনে করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান।
বেনারকে তিনি বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে অধিকার বিদেশি ডোনেশন বা তহবিল পাবে না। তবে স্থানীয় তহবিল পেলে কাজ চালাতে পারবে, যদিও সেই সুযোগ এখন নেই বললেই চলে।
এর ফলে সংগঠনটি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
বিদেশি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ বন্ধ হলে বাড়ি ভাড়া নেওয়া, ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করা থেকে শুরু করে স্বাভাবিক কাজ করতেও পদে পদে সংগঠনটি ঝামেলায় পড়বে বলে মনে করেন অধ্যাপক মিজান।
কারণ ‘ভীতি সৃষ্টি করা’
বর্তমান পরিস্থিতিতে অধিকারের পক্ষে কাজ চালিয়ে যাওয়া “প্রায় অসম্ভব” বলে মনে করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন।
অধিকারের নিবন্ধন বাতিল করার অন্যতম কারণ হলো “দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে এক ধরনের ভীতি সৃষ্টি করা,” মনে করেন তিনি।
“এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকার মানবাধিকার সংগঠন এবং সাংবাদিকদের এক ধরনর বার্তা দিয়েছে। তাহলো, কেউ যদি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনা করে তবে তাদের পরিণতিও একই হতে পারে,” বেনারকে বলেন লিটন।
তাঁর মতে, “মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, খুন, নির্যাতনের অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছর ডিসেম্বর র্যাবের ওপর মার্কিন সরকারের অবরোধ আরোপের পর সরকার মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ওপর নাখোশ। সেকারণেই অধিকার এর নিবন্ধন নবায়ন করা হয়নি।”
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর অধিকার এর প্রতিবেদন প্রায়শই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ব্যবহার করে থাকে।
গত বছর ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে এলিট ফোর্স র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের আরোপিত অবরোধের কারণে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ওপর সরকার নাখোশ।
গত ৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর অতিরিক্ত সচিব জিনাত আরা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, অধিকার এর নিবন্ধন ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ উত্তীর্ণ হয়েছে।
বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন-২০১৬ অনুযায়ী কোনো বেসরকারি সংগঠনের পূর্ববর্তী ১০ বছরের কার্যক্রম “সন্তোষজনক” হলে পরবর্তী ১০ বছরের জন্য নিবন্ধন নবায়ন করা হয়। এতে
বলা হয়েছে, অধিকার এর নবায়ন আবেদনপত্রে অসঙ্গতি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না দেয়া এবং বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কিত ব্যাখ্যা না দেয়া এবং রাষ্ট্রের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার কারণে সংস্থার কার্যক্রম সন্তোষজনক না হওয়ায় অধিকার এর নিবন্ধন নবায়নের আবেদনটি বিবেচনা করার সুযোগ নেই।
বেনারের হাতে চিঠির একটি অনুলিপি রয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, “‘অধিকার’ নামীয় সংস্থা কর্তৃক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে কথিত গুম-খুনসহ বিচারবহির্ভূত বিভিন্ন হত্যার বিষয়ে সংস্থার নিজস্ব ওয়েবসাইটে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করা হয়; যা বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ করে।”
২০০৯ থেকে ২০২১ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমখুনের ওপর অধিকার এর প্রতিবেদনে উল্লিখিত ব্যক্তিদের নাম ও পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা চাইলেও তা অধিকর সরবরাহ করেনি বলে জানানো হয় চিঠিতে।
নবায়নের আবেদন ‘ফেলে রাখা হয়েছে’ অনেক বছর
নবায়নের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই নিবন্ধন নবায়নের জন্য ২০১৪ সালের অক্টোবর এনজিও ব্যুরোর কাছে আবেদন করে অধিকার। তবে সেই আবেদনের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি ব্যুরো।
অধিকারের নিবন্ধন নবায়নের সিদ্ধান্ত ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা ছিল জানিয়ে অধিকারের আইনজীবী রুহুল আমিন ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, “কিন্তু সেটি করা হয়নি। বছরের পর পর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “সরকারের এই সিদ্ধান্তহীনতার বিরুদ্ধে আমরা ২০১৯ সালের ১২ মে আদালতে রিট আবেদন করি। অধিকারের নিবন্ধন নবায়নের জন্য আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়ে এই রিট আবেদন করা হয়। আদালত পরদিন ১৩ মে সরকারের প্রতি রুল জারি করে এবং আদালত ইতোমধ্যে ছয়টি শুনানি করেছেন। সর্বশেষ শুনানি হয় এবছর ২৬ মে।”
বিষয়টির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে আদালত যেসব কাগজপত্র চেয়েছে সেগুলোও দাখিলও করা হয়েছে জানিয়ে রুহুল আমিন বলেন, “বিষয়টি আগামীকাল (বুধবার) আদালতে পুনরায় শুনানি হতে পারে। অর্থাৎ অধিকারের নবায়নের বিষয়টি বিচারাধীন।”
তিনি বলেন, “এতদিন ধরে বিষয়টি এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর দপ্তরে ঝুলে রয়েছে। তারা কোনো সিদ্ধান্ত দিলো না। যখন বিষয়টি সুরাহার জন্য আদালতে শুনানি চলছে, তখন হঠাৎ নিবন্ধন নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত আসলো। বিষয়টি কতটুকু নৈতিক?”
নিবন্ধন বাতিলের আগে একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়ার কথা থাকলেও অধিকারকে কোনো প্রকার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়নি বলে জানান তিনি রুহুল আমিন।
তিনি বলেন, “অধিকার একটি আন্তর্জাতিক মানের মানবাধিকার সংগঠন। জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থার সাথে যে দুটি বাংলাদেশি সংস্থা কাজ করে অধিকার তাদের একটি। তারা নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য সংগঠন।”
অধিকার এর বর্তমান সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি. আর. আবরার ও সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান খান। আদিলুর ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন।
মানবাধিকার সংগঠন হিসাবে অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। শুরু থেকেই বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশসহ মানবাধিকার রক্ষার জন্য কাজ করে আসছে সংগঠনটি।
বাংলাদেশে সীমান্ত হত্যা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে সংগঠনটি সোচ্চার ছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অধ্যায়ে অধিকারের তথ্য নিয়মিতভাবে সংযোজন করা হতো।
আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে অধিকারের সমস্যা শুরু হয় ২০১৩ সালের মে মাসে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ইসলামি গ্রুপ হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ঘেরাওকে কেন্দ্র করে।
দেশে শরিয়া আইন প্রণয়ন ও তাদের ভাষায় নাস্তিক-ব্লগারদের ফাঁসির দাবিতে ঢাকার বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল ঘেরাও করে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে সারা দেশ থেকে ঢাকায় জড়ো হওয়া হেফাজত নেতাকর্মীরা, যাদের অধিকাংশই ছিল মাদ্রাসার ছাত্র। তারা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপারেশনে এক ঘণ্টার কম সময়ে ঢাকা ছেড়ে পালাতে থাকে হেফাজত কর্মীরা।
অধিকার এই অভিযান সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হেফাজত নেতার বরাত দিয়ে জানায়, এ অপারেশনে ২০২ জন নিহত হয়েছে এবং দুই হাজার ৫০০ হেফাজত নেতাকর্মী নিখোঁজ হয়েছেন।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অধিকার ওই অপারেশনে ৬১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়েছে।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর ১০ আগস্ট ২০১৩ আটক হন অধিকার সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও নির্বাহী পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান। ওই বছর ১১ অক্টোবর আদিলুর রহমান খান এবং পহেলা ডিসেম্বর ২০১৩ এলান মুক্তি পান।