মানবাধিকার লঙ্ঘন: বর্তমান আইজিপিসহ র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ
2021.12.10
ওয়াশিংটন ডিসি ও ঢাকা

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর বর্তমান ও সাবেক ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে মার্কিন সরকার।
এ ছাড়া বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মারাত্মকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনে যুক্ত থাকার অভিযোগ তুলে তাঁকে মার্কিন ভিসা না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে দেশটি।
পাশাপাশি, ২০১৮ সালে কক্সবাজার টেকনাফে পৌর কাউন্সিলর একরামুল হককে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যায় যুক্ত থাকার দায়ে র্যাব-৭ এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপরও সেদেশে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
শুক্রবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে বিশ্বের ১৫ ব্যক্তি এবং ১০ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের কথা ঘোষণা করে মার্কিন অর্থ বিভাগ। এর মধ্যে র্যাব এবং এর ছয় কর্মকর্তার নাম উল্লেখ আছে।
র্যাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আহ্বানের পরদিনই সংস্থাটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলো মার্কিন সরকার।
শুক্রবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবার নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা বিবৃতিতে এইচআরডব্লিউ জানায়, “বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের উচিত গুমের শিকার পরিবারগুলোর উপর উৎপীড়ন বন্ধ করা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের অবস্থান সম্পর্কে পরিবারগুলোকে অবগত করা।”
এ ছাড়া জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাহিনীটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটি।
র্যাবের বর্তমান ও সাবেক যেসব কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের আওতায় এসেছেন তাঁরা হলেন; বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক খান মোহাম্মদ আজাদ এবং তিন সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) তোফায়েল মুস্তফা সারোয়ার, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খান।
সিদ্ধান্তে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধের অংশ হিসাবে র্যাব যেসকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে সেখানে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এসেছে।
বলা হয়েছে, এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আইনের শাসন, মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে তুচ্ছ করে মার্কিন জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, র্যাবই বাংলাদেশের প্রথম কোনো বাহিনী যার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যে কোনো ধরনের অবরোধ ঘোষণা করল মার্কিন সরকার। ২০০৪ সালে বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে র্যাব গঠনের পর থেকে বন্দুকযুদ্ধ, জঙ্গিবাদ দমনে বিভিন্ন অভিযানসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে র্যাবের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী এবং গুম-খুনের শিকার পরিবারের সদস্যরা মার্কিন এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তবে, সরকারের পক্ষ থেকে মার্কিন সরকারের এই পদক্ষেপ সঠিক হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
মার্কিন এই পদক্ষেপ যৌক্তিক নয়: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
মার্কিন এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “মার্কিন সরকারের অবরোধের এই পদক্ষেপ কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। কারণ যেসব তথ্যের ভিত্তিতে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেটি বাস্তব চিত্র নয়।”
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে ১৭ কোটি মানুষ বাস করে। এ দেশে পুলিশি কার্যক্রম পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো সহজ নয়। এখানে আমাদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী অনেক ধৈর্যের সাথে দায়িত্ব পালন করে থাকে।”
মন্ত্রী বলেন, “দায়িত্ব পালনকালে তারা বিভিন্ন নিরাপত্তা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। কখনও কখনও তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়। আত্মরক্ষার অধিকার আইনে তাদের দেয়া আছে।”
“যখনই এ ধরনের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, সেক্ষেত্রে প্রতিটি ঘটনা ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তদন্ত করানো হয়। সেখানে যদি কোনো আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে, সেক্ষেত্রে আমরা দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রথমবারের মতো প্রশ্নের মুখোমুখি র্যাব
র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে গুমের শিকার পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমরা আনন্দিত। এই প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলাবাহিনী র্যাব কারও কাছ থেকে প্রশ্নের মুখোমুখি হলো। মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করে কোনো সিদ্ধান্ত এলো।”
তিনি বলেন, “দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের এই বেআইনি কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেনি।”
সানজিদা বলেন, “গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা তাদের বাবা-ভাইকে খুঁজে পেতে দেশের সকল প্রতিষ্ঠানের কাছে গেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।”
“আমরা আমাদের পরিবারের সদস্যদের খুঁজে পেতে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপের জন্য উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছি। কিন্তু সেখানেও কোনো প্রতিকার পাইনি,” বলেন সানজিদা।
সানজিদার ভাই ও বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনকে ২০১৩ সালের ০৪ ডিসেম্বর ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।
তিনি জানান, তাঁর ভাইকে র্যাব তুলে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “র্যাবসহ বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বাহিনী ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম, খুন চালিয়ে আসছে।”
তিনি বলেন, “এই সকল হত্যাকাণ্ড এবং গুম-খুনের ব্যাপারে আমরা এ দেশের মানবাধিকার কর্মীরা বারবার বলে আসলেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আমাদের কথা গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়নি। রাষ্ট্র বার বার এই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অস্বীকার করেছে।”
“আমাদের কথা গুরুত্বের সাথে না নেয়ার কারণে কথাগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে গেছে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিকভাবে যখন এই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত আসে তখন আমাদের আর কিছু বলার থাকে না,” বলেন নূর খান।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আমাদের দেশীয় কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত আসাটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। আমাদের কথাগুলো গুরুত্বের সাথে নেয়া হলে আজকে হয়তো এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।”
অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার কথা বিবেচনা করে ২০০৪ সালে বিএনপি সরকার এলিট ফোর্স র্যাব গঠন করে। তখন এই বাহিনী গঠনের বিরোধিতা করে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। কিন্তু ক্ষমতায় এসে এই বাহিনী বহাল রাখে আওয়ামী লীগ। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া র্যাব বিলুপ্ত করার দাবি জানান।
এই বাহিনীতে মূলত সেনা, বিমান ও নৌ-বাহিনীর সদস্যের পাশাপাশি পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন।
শুরুর দিকে ‘ক্রসফায়ারের’ নামে দেশের দাগী অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের ধরে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করলেও জনগণ তা অপছন্দ করেনি। পুরাতন ঢাকায় অধিবাসীরা ‘ক্রসফায়ারের’ দাবিতে মিছিলও করেছে।
তবে ধীরে ধীরে র্যাবের সদস্যরা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে হত্যা, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ করতে থাকলে প্রশ্নের মুখে পড়ে এই বাহিনী।
শুরু থেকেই মানবাধিকার কর্মীরা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবি জানালেও কোন সরকারই তা আমলে নেয়নি।
বেসরকারি সংস্থার বরাত দিয়ে মার্কিন অর্থ বিভাগ জানায়, র্যাব ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ থেকে ৬০০ এর বেশি গুম এবং ২০১৮ সাল থেকে প্রায় ৬০০ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের জন্য দায়ী।