মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দায়িত্ব নিলেন নতুন পুলিশ প্রধান

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.09.30
ঢাকা
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দায়িত্ব নিলেন নতুন পুলিশ প্রধান পুলিশের বিদায়ী মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাংলাদেশ ড. বেনজীর আহমেদের (ডানে) কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছেন নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২।
[সৌজন্যে: পুলিশ সদরদপ্তর]

বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের পর শুক্রবার নতুন আইজিপি হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন, যাঁর বিরুদ্ধেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মতে, নতুন আইজিপি “একজন সৎ, পরিশ্রমী ও নীতিবান অফিসার।”

চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের “অবরোধ সঠিক হয়নি,” মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেনারকে বলেন, “তিনি কখনও র‍্যাব অথবা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) কাজ করেননি।”

কেবলমাত্র র‍্যাবের র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) মহাপরিচালক হওয়ার কারণেই চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে মার্কিন অবরোধ আরোপ করা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।

নতুন আইজিপি আর মাত্র চার মাস পরে অবসরে যাবেন বলেও জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর মধ্যে র‍্যাব ও গোয়েন্দা বিভাগের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের সদস্য এবং বিভিন্ন মানুষকে উঠিয়ে নিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে করেছে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

সরকারের পক্ষ থেকে বরাবর গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করা হচ্ছে।

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে গত বছর ১০ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠান হিসাবে র‍্যাব, র‍্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন, র‍্যাবের সাবেক ডিজি এবং আইজিপি বেনজীর আহমেদসহ সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে মার্কিন সরকার।

বাংলাদেশের ইতিহাসে মার্কিন সরকারের অবরোধ আরোপের ঘটনা এটিই প্রথম। অবরোধের পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও ক্রসফায়ারের ঘটনা অনেকটাই কমে এসেছে।

বিরোধী দল এবং ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা এই অবরোধকে সমর্থন করেছেন।

অবসরে গেলেন আলোচিত-সমালোচিত ড. বেনজীর

শুক্রবারই বেনজীর আহমেদ অবসরে গেছেন বলে জানানো হয়েছে সরকারি প্রজ্ঞাপনে। তবে তিনি পুলিশ প্রহরায় থাকবেন।

বেনজীর আহমেদ ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। তিনি ৩৪ বছর সাত মাস বিভিন্ন পদে চাকরি করেছেন।

বিরোধী দলের সরকার বিরোধী সহিংস আন্দোলনের মুখে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে র‍্যাবের মহাপরিচালক নিয়োগ করে সরকার। তিনি সেই সহিংস আন্দোলন শক্ত হাতে দমন করেন। ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত র‍্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। এরপর তিনি আইজিপি পদে পদোন্নতি পান।

বেনজীর আহমেদ ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার ছিলেন, হেফাজতে ইসলাম শাপলা চত্বর অবরোধ করে সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দিলে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হিসেবে ওই আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে নেতৃত্ব দেন।

বিরোধী দলগুলো বরাবরই বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বাধীন র‍্যাব-পুলিশের সমালোচনা করে আসছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বেনজীর আহমেদ তাঁর দায়িত্ব পালনকালে বিরোধীদলকে দমন করতে যা যা করেছেন সেটি মূলত সরকারের নির্দেশে করেছেন। বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটায় র‍্যাব ও এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এটি লজ্জাজনক।”

র‍্যাব ও পুলিশের হাতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম শুক্রবার বেনারকে বলেন, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ছয়শ মানুষ নিখোঁজ রয়েছে, যাঁদের অনেককেই বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বে থাকা র‍্যাব ও পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে।

“বেনজীর আহমেদ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান র‍্যাব-পুলিশকে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনে পরিণত করেন। উনি সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে যুক্ত ছিলেন,” বলেন সানজিদা।

২০১৮ সালের ২৬ মে তথাকথিত ‘ক্রসফায়ার‘ এর নামে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর ও টেকনাফ যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ একরামুল হককে গুলি করে হত্যার জন্য মারাত্মক সমালোচনায় পড়ে র‍্যাব।

একরামকে যখন কাছ থেকে গুলি করা হয় তখন তাঁর স্ত্রী মোবাইল ফোনে যুক্ত ছিলেন এবং তিনি গুলির শব্দসহ পুরো ঘটনাটি রেকর্ড করে সাংবাদিকদের দেন।

একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বন্দুকযুদ্ধের নামে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে আমার স্বামীকে গুলি করে র‍্যাব হত্যা করেছিল,..।”

“শুনেছি র‍্যাবের তৎকালীন দায়িত্বে থাকা বেনজীর সাহেব বিদায় বেলায় আমার স্বামীকে অপরাধী বলেছেন। এটা শুনে খুবই কষ্ট পেয়েছি। তাঁর আমলে আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর জবাব তিনি দিতে পারবেন বলে মনে হয় না,” বলেন আয়েশা।

পুলিশের কার্যক্রমে ব্যতিক্রম ঘটবে না

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের মতে, আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিদায়ে পুলিশের কার্যক্রমে কোনো ব্যতিক্রম ঘটবে না।

“বাংলাদেশের সকল সরকারই ধারাবাহিকভাবে পুলিশকে বিরোধীদের দমনে ব্যবহার করে আসছে,” মন্তব্য করে তিনি বেনারকে বলেন, “সে কারণে পুলিশ, র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কেউ যাচ্ছেতাই করলেও তাদের কিছুই হয় না।”

তবে তাঁর মতে, বেনজীর আহমেদ ২০১৫-১৬ সালে জঙ্গি হামলা পরবর্তী সময়ে উগ্রবাদী সংগঠনগুলোকে “খুব শক্ত হাতে দমন করেছেন।”

“জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দিতে র‍্যাব বিরাট ভূমিকা পালন করে। এজন্য তিনি কৃতিত্ব পাওয়ারও দাবিদার,” বলেন ড. মিজানুর রহমান।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন টেকনাফ থেকে আব্দুর রহমান

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।