ফেনী নদীর ওপর মৈত্রী সেতু: সরাসরি যুক্ত হলো বাংলাদেশ-ভারত
2021.03.09
ঢাকা

ইতিহাসে প্রথমবার একটি সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরাসরি যুক্ত হলো ভারতের সাথে। সীমান্তবর্তী ফেনী নদীর ওপর নির্মিত এই সেতুটির নামকরণ করা হয়েছে মৈত্রী সেতু।
মঙ্গলবার ভার্চুয়ালি যৌথভাবে এই সেতু উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই সেতুর মাধ্যমে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়ের সাথে সরাসরি সংযুক্ত হলো ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম এলাকা।
এর ফলে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
“আমি মনে করি এই সেতু আমাদের দুই দেশের মাঝে শুধু সেতুবন্ধনই রচনা করবে না, বরং ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখবে,” সেতু উদ্বোধনের সময় বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই মৈত্রী সেতুর মাধ্যমে ত্রিপুরার পাশাপাশি দক্ষিণ আসাম ও মণিপুর রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে বলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জানান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সেতুটি চালু হবার পর শুধু চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর নয় বরং “চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও ত্রিপুরাবাসী ব্যবহার করতে পারবে,” জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এই সেতুটি ভারতের পাশাপাশি নেপাল- ভুটানের সঙ্গেও বাংলাদেশের বাণিজ্যকে সহজ করবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে এই সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ২০১৫ সালের জুন মাসে। এর আগে ২০১০ সালে ত্রিপুরার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ফেনী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের প্রস্তাব দেন বলে জানান শেখ হাসিনা।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের জন্য এই ব্রিজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, পণ্য পরিবহনের জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। এই সেতুটি উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য একটি বাণিজ্যিক লাইফলাইন হবে।
“ফেনী সেতু চালুর মধ্যে দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্বের ল্যান্ডলকড রাজ্যগুলো বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে পণ্য পরিবহন করতে পারবে। আগে ১৬০০ কিলোমিটার দূরে আগরতলার নিকটতম সমুদ্রবন্দর ছিল কলকাতা। বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে আগরতলার নিকটতম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারেরও কম,” বলেন শেখ হাসিনা।
বাড়বে আয় ও যোগাযোগ
“এই মৈত্রী সেতু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে,” বলে বেনারকে জানান বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ. মনসুর।
তিনি বলেন, “এই সেতু নির্মাণের ফলে স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে সেখানে যাবে। ফলে এই বন্দরের আয় বাড়বে এবং গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে।”
তবে বাংলাদেশ এই সেতুর অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে পারবে কি না তা “চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কীভাবে পণ্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে” তার ওপর নির্ভর করবে বলে বেনারকে জানান বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
“যদি ভারতীয় ট্রাকগুলো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে সরাসরি চলে যায় তাহলে আমরা খুব বেশি সুবিধা পাবো না। কিন্তু যদি আমাদের ট্রাকও বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে সরাসরি যেতে পারে তাহলে আমাদের লাভ হবে,” বলেন ড. মোস্তাফিজ।
সোমবার ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ফেনী নদীর ওপর নির্মিত মৈত্রী সেতুটি দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতীক’।
এতে বলা হয়, ভারতীয় ১৩৩ কোটি রুপি (প্রায় ১৫৫ কোটি টাকা) ব্যয়ে এক দশমিক নয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুটি নির্মাণ করেছে ভারতের ন্যাশনাল হাইওয়েজ অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপ কর্পোরেশন লিমিটেড।
এই সেতু ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে এক নবদিগন্তের সূচনা করবে আশা প্রকাশ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এর মাধ্যমে ভারতের সাবরুম থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরের যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের প্রবেশদ্বার হতে চলেছে ত্রিপুরা রাজ্য।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, সাবরুমে সমন্বিত চেকপোস্ট স্থাপন করার মাধ্যমে দুদেশের মধ্যে মানুষ ও পণ্য চলাচল বৃদ্ধি পাবে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে নতুন বাজারের সুযোগ বয়ে আনবে এবং কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করা যাবে।
বর্তমান ব্যবস্থা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ট্রাক চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেবে এবং ভারতীয় সীমান্ত থেকে সে দেশের ট্রাক পণ্যগুলো তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিয়ে যাবে বলে বেনারকে জানান ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ।
চীনের পরই বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার ভারত। ভারতীয় দূতাবাসের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুসারে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ভারত থেকে প্রায় পাঁচ দশমিক আট বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে ভারতে রপ্তানি করেছে প্রায় এক দশমিক এক বিলিয়ন ডলারের পণ্য।
বাংলাদেশে মোট ৪৬টি প্রকল্পের বিপরীতে ভারত তিন ধাপে সাড়ে সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেবার কথা রয়েছে বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্মসচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী।
প্রকল্পগুলোর মধ্যে ১৪টি শেষ হয়েছে, আটটি চলছে এবং ১৫টি প্রকল্প দরপত্র প্রক্রিয়ায় রয়েছে জানিয়ে শাহরিয়ার কাদের বলেন, মোট ঋণের মধ্যে এ পর্যন্ত প্রায় ৭২০ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে ভারত।
তবে ফেনী নদীর ওপর তৈরি ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুটি ভারতীয় ঋণের আওতায় নির্মিত নয় বলে জানান তিনি।