উপকূলে রাডার স্থাপনের বিষয়ে ভারতের সাথে সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ
2019.10.07
ঢাকা

উপকূলে সর্বক্ষণিক মনিটরিং ব্যবস্থার (কোয়েস্টাল সারভাইল্যান্স সিস্টেম-সিএসএস) বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে ভারত ও বাংলাদেশ।
এর আওতায় বাংলাদেশের উপকূলে ২০টি রাডার সিস্টেম নেটওয়ার্ক স্থাপন করবে ভারত। বলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর এলাকায় কড়া দৃষ্টি রাখবে ভারত, যা সমুদ্রপথে যেকোনো সন্ত্রাসী হামলা সনাক্ত করার পাশাপাশি প্রতিবেশীদের নৌ সীমানায় দৃষ্টি রাখতে পারবে।
তবে বিষয়টি চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, এ অঞ্চলে চীনা যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনের উপস্থিতির কারণেই ভারত এই ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, “চীন দেখবে এই এমওইউয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ তাঁদের বিরুদ্ধে কাজ করছে, যা আমাদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।”
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বরাবরই বলে এসেছেন আমাদের ভূমি ব্যবহার করে অন্য রাষ্ট্রের ক্ষতি তিনি করতে দেবেন না। কিন্তু ভারতের সাথে এই চুক্তি তাঁর সেই বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিরোধী অবস্থান।”
এর বিরোধিতা করে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের সমুদ্র উপকুলে ভারতীয় নৌবাহিনীর আধিপত্য নজরদারি বিস্তারের অনুমোদন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।
ভারতীয় বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জয়ন্ত বলেন, বাংলাদেশে ২০টি রাডার কেন্দ্র স্ট্রাটেজিক লক্ষ্যে বসানো হচ্ছে, নাকি উপকূলে দুই পক্ষের প্রয়োজনীয় নজরদারির জন্য বসানো হচ্ছে, সেটি তাঁর কাছে এখন পর্যন্ত স্পষ্ট না।
গত ৫ অক্টোবর শেখ হাসিনা–নরেন্দ্র মোদি বৈঠকে মংলা ও চট্টগ্রামের বন্দর ব্যবহার, উপকূলে রাডার স্থাপনসহ ভারতকে বেশ কিছু সুবিধা দিয়ে মোট সাতটি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি হয়।
ভারতকে ‘সামান্য’ পানি
দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির জট না খুললেও ফেনী নদীর পানি পেতে যাচ্ছে ভারত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় এ বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ।
আর এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সফরের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে বক্তৃতা–বিবৃতি দিচ্ছে। তবে ভারতের বিশেষজ্ঞরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফর ও চুক্তি সইয়ের বিষয়টিকে দেখছেন সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়াস হিসেবে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “নয় বছর ধরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ঝুলে থাকা অবস্থায় পরিমাণে কম হলেও ফেনী নদীর পানি নিয়ে চুক্তি হওয়াটা দৃষ্টিকটু।”
“ছোট হোক, আর বড় হোক—ভারতের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো এগোচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়গুলো নিয়ে তেমন কোনো কথাবার্তা নেই। যেসব চুক্তি হয়েছে তার কোনোটাই খুব বেশি বড় কিছু না। তবে দেখতে ভালো লাগছে না। কারণ আমাদের স্বার্থ বরাবরই পেছনে চলে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।
তবে বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন।
তিনি বেনারকে বলেন, “ফেনী নদীর পানি ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে বাংলাদেশ উদারতার পরিচয় দিয়েছে। ভারত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করতে না পারলেও বাংলাদেশের দিক থেকে সম্পর্কটাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়নি।”
তাঁর মতে, কূটনৈতিক বা রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নতুন করে আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অন্যতম ফেলো অধ্যাপক জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বেনারকে বলেন, ভারত এই সফর থেকে অনেক লাভবান হয়েছে ঠিকই। ফেনী নদীর পানি পাচ্ছে, পাচ্ছে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস। তবে ভারত কোনওভাবেই অতিরিক্ত সুবিধা আদায়ের মনোভাব নিয়ে চলছে বলে মনে হয় না।
“তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি আসলেই খুবই জটিল। এই সমস্যার সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে নানা বিষয় পর্যালোচনা করে ভারতকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই কাজটিই দুই দেশকে একসঙ্গে বসেই করতে হবে। শুধুমাত্র পানির প্রবাহ হিসাব করে তার সমাধান সম্ভব নয়,” বলেন অধ্যাপক জয়ন্ত।
তাঁর মতে, শেখ হাসিনার ভারত সফর দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক আরও জোরদার করবে।
দু্ই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে সই হওয়া এমওইউর আওতায় দুই দেশের অভিন্ন ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি তুলে নেবে ভারত।
২০১১ সাল থেকে তিস্তার মতো ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হলেও তা ঝুলে ছিল। ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহরে খাবারের পানি সংকট মেটাতে নেওয়া প্রকল্পের জন্য ফেনী নদী থেকে পানি তোলার ব্যাপারে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়ে আসছিল ভারত।
রোববার এক সংবাদ বিবৃতিতে বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পানি শুধুমাত্রই পানের জন্য বলেই মানবিকতা ও প্রতিবেশীসুলভতাকে বিবেচনা করে তাতে সম্মতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রণালয় জানায়, শুকনা মৌসুমে ফেনী নদীর পানির গড় পরিমাণ ৭৯৪ কিউসেক এবং বার্ষিক পানির গড় পরিমাণ প্রায় ১৮৭৮ কিউসেক। ভারত যে পানি নেবে, তার পরিমাণ ‘খুব সামান্য’ অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমের গড় পানি প্রবাহের মাত্র ০.২৩ শতাংশ।
যদিও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০০৫ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ বইয়ে বলা হয়েছে, শুকনো মৌসুম অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ফেনী নদীতে ১.৩৫ কিউবিক মিটার বা ৪৭ কিউসেক পানি থাকে।
তিস্তার বিষয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে দুই সরকারের সম্মতি অনুযায়ী তিস্তা নদীর পানি বণ্টনে বাংলাদেশের মানুষের অপেক্ষার কথা তুলে ধরেন।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানান, সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে এই চুক্তির বিষয়ে সমাধানে পৌঁছাতে ভারতের সব অংশীদারের সঙ্গে কাজ করছে তাঁর সরকার।
উল্লেখ্য, সব ধরনের প্রস্তুতি থাকার স্বত্বেও ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে আটকে যায় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে একমত ভারত
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘নিরাপদ, দ্রুত ও টেকসই’ প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একমত হয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ফেরার জন্য রাখাইনে নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নসহ ‘বৃহত্তর প্রচেষ্টা’ নেওয়ার প্রয়োজন সম্পর্কেও ঐকমত্য প্রকাশ করেন তাঁরা।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ভারতের এই বিবৃতি গতানুগতিক। বেনারকে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সাথে তথাকথিত ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখছে ভারত। কাজেই যারা আশা করছিল ভারত সাহায্য করবে তারা ভুল করছিল। এই বিবৃতি তার প্রমাণ, এখানে নতুন কিছু নেই।”
তবে অধ্যাপক দেলোয়োর হোসেন মনে করেন, “রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতকে কূটনৈতিকভাবে আগের চেয়ে আরো পজিটিভ মনে হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কটাও তাদের কাছে জাতীয় স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থানটা তারা বুঝছে এবং ক্রমশ তাদের অবস্থান পরিবর্তন হচ্ছে।”
এনআরসি নিয়ে আশ্বাস
যৌথ বিবৃতিতে ভারতের নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়নি। তবে বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয় বলে সাংবাদিকদের জানান পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক।
তিনি বলেন, “এনআরসি ইস্যুতে বলেছি, আমরা মনে করি এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরা আশা করি, বন্ধু দেশ হিসেবে ভারত তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।”
উল্লেখ্য, সম্প্রতি ভারতের আসাম সরকার প্রকাশিত চূড়ান্ত এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের (১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন) বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে দেশটির একাধিক মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতারা বক্তব্য দিচ্ছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানান, এটি ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ এবং এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না।
এছাড়াও দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ভারতের ব্যবহারের বিষয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি)’ সই হয়েছে। এর ফলে নির্ধারিত মাসুলের বিনিময়ে এই বন্দর দুটি ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে নিজেদের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য আনা নেওয়া করতে পারবে ভারত।
এ ছাড়া ভারতের এসব রাজ্যে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি রপ্তানি করতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ক একটি প্রকল্প উদ্বোধন করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। এই প্রকল্পে বাংলাদেশ থেকে বুলেট ট্রাকে করে ত্রিপুরার বিশালগড় বটলিং প্ল্যান্টে এলপিজি নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের বিভিন্নস্থানে এলপিজি সরবরাহ করা হবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বেনারকে বলেন, “বরাবরই বাংলাদেশ ভারতকে সবসময় দিয়েই গেছে। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।”
তাঁর মতে, “বাংলাদেশের নতজানু পররাষ্ট্র নীতি এবং নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা না করে ভারতের জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করার নীতি দেশকে একটা করদ রাজ্যে পরিণত করছে।”
বিরোধী দলগুলোর নিন্দা
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে সই হওয়া সমঝোতা স্মারক ও চুক্তিগুলোর নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার, ফেনীর নদীর পানি ত্রিপুরায় সরিয়ে নেওয়া এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে গ্যাস পাঠানোর যে চুক্তি করা হল তা স্পষ্টভাবে সংবিধান পরিপন্থি।” অবিলম্বে এসব চুক্তি বাতিলের দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়েছে।