চালু হচ্ছে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেললাইন, উদ্বোধন করবেন ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী

কামরান রেজা চৌধুরী ও পরিতোষ পাল
2020.12.16
ঢাকা ও কলকাতা
চালু হচ্ছে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেললাইন, উদ্বোধন করবেন ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চালু হওয়া প্রথম ট্রেন মৈত্রী এক্সপ্রেস ঢাকার কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে যাবার সময় যাত্রীদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন উপস্থিত জনসাধারণ। ১৪ এপ্রিল ২০০৮।
[রয়টার্স]

দীর্ঘ ৫৫ বছর পর আবার চালু হচ্ছে পাকিস্তান আমলে বন্ধ হয়ে যাওয়া চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথ। এটি চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির পথ সুগম হবে বলে জানান বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা। 

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ-ভারত প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠকের পর যৌথভাবে এই রেলপথের উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। 

“বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেল লাইনটি চালু হবে। উদ্বোধনের পর চিলাহাটি থেকে একটি খালি ট্রেন হলদিবাড়ি যাবে,” বুধবার বেনারকে বলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) সরদার সাহাদাত আলী। 

লাইনটি চালু হবার পর প্রথম পর্যায়ে শুধু মালবাহী গাড়ি চলবে জানিয়ে তিনি বলেন, “সব ঠিক থাকলে আগামী বছর ২৬ মার্চ এই রেলপথ দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করবে। তখন এই রেলপথটি আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।” 

চিলাহাটি রেলস্টেশনটি বাংলাদেশের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় নীলফামারি জেলায় অবস্থিত। সীমান্তের ওপারেই ভারতের কোচবিহার জেলায় হলদিবাড়ি স্টেশন। এই স্টেশনটি কলকাতা, দার্জিলিংসহ অন্যান্য ভারতীয় রেললাইনের সাথে যুক্ত। 

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে হলদিবাড়ি-চিলাহাটি রেল পথের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে বেনারকে জানান ভারতের উত্তর-পূর্ব রেলওয়ের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক শুভানন্দ চন্দ।

“তবে এই রেলপথের উদ্বোধন উপলক্ষে হলদিবাড়ি স্টেশন সাজানো হয়েছে,” বলেন তিনি।

দুই অঞ্চলের রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, আগে শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেল চলত গেদে-দর্শনা এবং চিলাহাটি-হলদিবাড়ি হয়ে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে রেলপথটি বন্ধ হয়ে যায়। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই রেলপথটি আর চালু হয়নি। দুই স্টেশনের মধ্যে ১১ কিলোমিটারের বেশি জায়গায় রেলপথ ছিল না। 

২০১৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ-ভারত রেলওয়ে সভায় দুদেশের প্রতিনিধিরা চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথটি আবার চালুর সুপারিশ করেন। সে অনুযায়ী, দুই দেশের সরকার চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রুটটি চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। 

পরবর্তীতে ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ অংশের সাড়ে ছয় কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করে বাংলাদেশ সরকার। ভারতীয় অংশের সাড়ে চার কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করে ভারত সরকার। 

হলদিবাড়ি স্টেশন থেকে ভারত-ভুটান সীমান্ত স্টেশন হাসিমারা পর্যন্ত রেলপথ বিস্তৃত। চিলাহাটি থেকে হাসিমারা স্টেশনের দুরত্ব প্রায় ১৭৩ কিলোমিটার। একইভাবে চিলাহাটি থেকে ভারত-নেপাল সীমান্ত স্টেশন বীরগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। 

“চিলাহাটি-হলদিবাড়ি হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগের সবচেয়ে সুবিধাজনক স্টেশন। এই রুট ব্যবহার করে চার দেশের মধ্যে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য সুবিধা কাজে লাগানো সম্ভব,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের উপপরিচালক (ইন্টারচেঞ্জ) কালিকান্ত ঘোষ। 

তিনি বলেন, “প্রতি বছর বাংলাদেশে থেকে বহু পর্যটক অনেক পথ ঘুরে দার্জিলিং বেড়াতে যান। এই রুট ব্যবহার করে খুব সহজেই দার্জিলিং, নেপাল ও ভুটান যাওয়া সম্ভব। এতে অর্থ ও সময় দুই-ই সাশ্রয় হবে।” 

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির আগে কলকাতার শিয়ালদহ থেকে গেদে-দর্শনা এবং চিলাহাটি-হলদিবাড়ি হয়ে দার্জিলিং মেইল রেলগাড়ি চলাচল করত।

একসময় ভারত ও বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে সাতটি রেলপথ চালু ছিল। এই রেলপথগুলো দিয়ে মালবাহী ও যাত্রীবাহী রেলগাড়ি চলাচল করত।

রেলপথগুলো হলো; গেদে-দর্শনা, পেট্রাপোল-বেনাপোল, সিংগাবাদ-রোহনপুর, রাধিকাপুর-বিরল, হলদিবাড়ি-চিলাহাটি, মহিশাসন-শাহবাজার এবং আগরতলা-আখাউড়া। 

পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ বাসিন্দা ও সাবেক স্কুল শিক্ষক রবীন হালদার (৮০) বেনারকে বলেন, আগে ভারত ও তৎকালীন পূর্ববাংলার (বাংলাদেশ) মধ্যে কলকাতা, গোয়ালন্দ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনার মধ্যে নিয়মিত রেলগাড়ি চলাচল করত। এর মধ্যে “সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল শিয়ালদহ ও খুলনার মধ্যে চলাচলকারী বরিশাল এক্সপ্রেস।” 

“শিয়ালদহ থেকে গেদে-দর্শনা হয়ে পার্বতীপুর পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গল মেইল এবং শিয়ালদহ থেকে গোয়ালন্দঘাট পর্যন্ত চলাচলকারী ইস্টবেঙ্গল এক্সপ্রেস। দুই বাংলার মধ্যে এই রেলগাড়িগুলোতে নিয়মিত মানুষ যাতায়াত করত,” বলেন রবীন হালদার।

২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিল ১৯৬৫ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া ঢাকা-কলকাতা রুটে যাত্রীবাহী রেলগাড়ি চলাচল শুরু হয়। মৈত্রী এক্সপ্রেস নামে চালু হওয়া এই ট্রেনটিই ছিল বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চালু হওয়া প্রথম রেলগাড়ি। 

২০১৭ সালের নভেম্বরে খুলনা-কলকাতা রুটে যাত্রীবাহী বন্ধন এক্সপ্রেস নামে রেলগাড়ি চলাচল শুরু হয়। 

হাসিনা-মোদি ভার্চুয়াল বৈঠক

রেললাইন উদ্বোধন ছাড়াও বৃহস্পতিবার দুই প্রধানমন্ত্রী উভয় দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করবেন। 

অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, রোহিঙ্গা সমস্যা, দুই দেশের হাতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়ন ইত্যাদি নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করবেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন। 

মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের শীর্ষ বৈঠক শেষে ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হতে পারে। তবে এগুলোর নাম জানাননি তিনি। 

তবে তিনি জানান, মহাত্মা গান্ধী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ওপর একটি জাদুঘর দুই প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন।

মন্ত্রী বলেন, “ভারত আমাদের রক্তের বন্ধু, ১৯৭১ সালে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আগে আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে ভারত।” 

দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী গত বছরের অক্টোবরে নয়াদিল্লিতে সর্বশেষ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন।

চলতি বছরের মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবাষির্কীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় আসার কথা থাকলেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ায় সে সফর আর হয়নি। 

পরবর্তীতে অনুষ্ঠান উদ্বোধনী উপলক্ষে একটি ভিডিও বার্তা পাঠান ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

এছাড়া গত মার্চে করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সার্ক নেতাদের ভিডিও কনফারেন্সেও অংশগ্রহণ করেন ভারত ও বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।