বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ-লিবিয়া সমঝোতা স্মারক অবৈধ পথে ইউরোপ যাত্রা থামবে না

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.10.27
ঢাকা
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ-লিবিয়া সমঝোতা স্মারক অবৈধ পথে ইউরোপ যাত্রা থামবে না অবৈধভাবে লিবিয়া থেকে ইউরোপ যাবার সময় ভূমধ্যসাগরে বিকল নৌকায় থাকা বাংলাদেশি যাত্রীদের লাইফ জ্যাকেট দিচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। ২৫ আগস্ট ২০২২।
[এপি]

লিবিয়ার সাথে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সমঝোতা স্মারক অবৈধভাবে ইউরোপ যাত্রা ঠেকানোর বদলে ভূমধ্যসাগর হয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশিদের ইউরোপ প্রবেশের চেষ্টা বাড়াতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, লিবিয়ার যে দুটি শহরের (বেনগাজি ও তব্রু) ওপর দিয়ে ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে ইতালি ও গ্রিস যাওয়া যায় সেখানে ত্রিপলি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। ওই দুটি শহরে যেতে পাসপোর্ট বা ভিসাও লাগে না।

২০১১ সালে মোয়াম্মের গাদ্দাফির মৃত্যুর পর থেকে তেল সমৃদ্ধ দেশটির পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি সরকার রয়েছে। বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমাংশের ত্রিপলি ভিত্তিক সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।

গত ২৫ অক্টোবর লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে জনশক্তি রপ্তানি সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ ও লিবিয়া সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই সমঝোতা স্মারক অনিয়মিত অভিবাসন প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে।

ভৌগলিকভাবে লিবিয়ার অবস্থান ইতালি ও গ্রিসের ঠিক নিচে। মাঝখানে ভূমধ্যসাগরের চ্যানেল। ওই চ্যানেল অতিক্রম করে ইউরোপ প্রবেশের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চক্র গড়ে উঠেছে।

গত কয়েক বছরে যেসব দেশের নাগরিকরা লিবিয়া হয়ে অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা অন্যতম। কখনও কখনও শীর্ষ অবস্থানে থাকেন বাংলাদেশিরা।

ঝুঁকিপূর্ণ এবং অবৈধপথে ইউরোপ যেতে লাখ লাখ টাকা খরচ করেন বাংলাদেশিরা।

অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান সাইফুল হক বেনারকে বলেন, “সমঝোতা স্মারক হয়েছে, সেটি ইতিবাচক। এর ফলে সেখানে অবস্থিত অনিয়মিত বাংলাদেশিদের নিয়মিত করা যাবে।”

তিনি বলেন, “তবে এর ফলে দালালদের মাধ্যমে ইউরোপ যাওয়া কমবে অথবা বন্ধ হবে সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ লিবিয়াতে কার্যত কোনো সরকার নেই। দুই দিকে দুই সরকার। আবার বাংলাদেশিরাও ইউরোপ প্রবেশের চেষ্টা ছাড়বে না।”

এই সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশিরা সহজে লিবিয়া গিয়ে সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে ইতালি চলে যাবে বলে মনে করেন সাইফুল হক।

তাঁর মতে, এই স্মারকের কারণে অবৈধভাবে ইউরোপ যাবার “প্রবণতা বন্ধ হবে না। বরং, বাড়বে।”

তিনি বলেন, “যাঁরা ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করবেন তাঁরা ভুয়া ডিমান্ড লেটার দিয়ে লিবিয়া যাবে। সেখানে থেকে ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে ইউরোপ চলে যাবে।”

বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের অভিবাসন শাখার প্রধান শরিফুল হাসান এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরকে ইতিবাচক হিসাবে বর্ণনা করে বলেন, “এর ফলে অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়া বন্ধ হবে, সে কথা বলা যায় না। এটি বন্ধ হবে না। কারণ লিবিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয়। সেখানে মানবপাচারকারী চক্র সক্রিয়।”

তিনি বলেন, “তবে এই সমঝোতা এবং এর ভিত্তিতে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে যাঁরা লিবিয়া যাচ্ছেন তাঁদের ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যাবে।”

সরকার যা বলছে

লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ খায়রুল বাশার শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আমরা লিবিয়ার ত্রিপলি সরকারের সাথে সমঝোতা স্মারক সই করেছি। এরপর এ বিষয়ে আরেকটি চুক্তি হবে। সেই অনুসারে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি এখানে পাঠানো যাবে। পূর্বাঞ্চলীয় সরকারের সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।”

লিবিয়ায় এখন দুটি সরকার; একটি ত্রিপলি ভিত্তিক সরকার এবং আরেকটি পূর্বাঞ্চলীয় শহর বেনগাজি ও তব্রু ভিত্তিক সরকার যারা ত্রিপলি সরকারকে মানে না।

দুই পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আগামী আট মাসের মধ্যে একটি সরকার গঠন করতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

রাষ্ট্রদূত বাশার বলেন, “দুই পক্ষ মিলে একটি সরকার গঠিত হলে এই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী চুক্তির আওতায় আমরা জনশক্তি পাঠাতে পারব। অন্যথায় অন্য দেশগুলো সেই সুযোগ নেবে।”

দালালদের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার ঝুঁকির বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, “ঝুঁকি রয়েছে। বর্তমানে যারা লিবিয়ায় আসে তাদের অনেকেরই উদ্দেশ্য হলো এখান থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়া।”

তিনি বলেন, “দালালরা আগ্রহীদের বলে ‘তোমরা চলে আসো, কোন টাকা পয়সা লাগবে না’। এরপর লিবিয়ায় আসার পর তাদের আটকে রেখে, নির্যাতন করে টাকা পয়সা আদায় করে এবং তাদের নৌকাযোগে ইতালি পাঠায়।”

খায়রুল বাশার বলেন, এজন্য তারা ছয় থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে থাকে।

কোন পথ দিয়ে তাদের ইতালিতে পাঠানো হয়-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রথমে বাংলাদেশ থেকে দুবাই। সেখান থেকে তারা বেনগাজি ও তব্রু যায়। সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইতালি চলে যায়।”

রাষ্ট্রদূত বলেন, “২০২১ সালে ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে অবৈধভাবে ১৪ হাজার এবং এ বছর ছয় হাজার বাংলাদেশি ইতালি গেছেন বলে বিভিন্ন সংস্থা আমাদের জানিয়েছে।”

তিনি বলেন, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের আগে সেখানে এক লাখ ২১ হাজার বাংলাদেশি কাজ করতেন। গৃহযুদ্ধের পর সেখানে ২১ হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন।

রাষ্ট্রদূত বলেন, বর্তমানে সহিংস ঘটনা কমে আসার প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে।

তবে আনুষ্ঠানিক হিসাবের বাইরে হাজার হাজার বাংলাদেশি প্রতিবছর মানব পাচারকারীদের সহায়তায় লিবিয়ার বেনগাজি ও তব্রু হয়ে ইতালি ও গ্রিস যায়। ভূমধ্যাসাগর অতিক্রমকালে নৌকা উল্টে শত শত মানুষ প্রাণ হারায়। তবুও এই মরণযাত্রা বন্ধ হয়নি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।