চাঁপাইনবাবগঞ্জে বজ্রপাতে ২০ বরযাত্রী নিহত
2021.08.04
ঢাকা

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে বৌভাত অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে বজ্রপাতে পাঁচ নারী ও নতুন বরসহ ২০ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে। বুধবার দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার চরপাকা ইউনিয়নে পদ্মা নদীর তেলিখাড়ি ঘাটে এই ঘটনা ঘটে বলে জানান স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জালাল উদ্দিন।
তিনি বেনারকে জানান, “মৃতদের মধ্যে একজন আমার ইউনিয়নের এবং বাকিরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা।”
“বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ১৪ জন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও ছয়জনের মৃত্যু হয়। আহত আরো দুইজন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আছে,” বলেন চেয়ারম্যান জালাল।
নিহতরা নারায়ণপুর ইউনিয়নের আলীমনগর থেকে নৌকায় করে দক্ষিণ পাঁকায়তের রশিয়া গ্রামে বৌ ভাতের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন বলে বেনারকে জানান শিবগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
বৃষ্টি শুরু হলে তাঁরা ঘাটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেই বজ্রপাত হয়, জানিয়ে তিনি বলেন, “তিনি বলেন, “ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম, খুবই মর্মান্তিক দৃশ্য।”
“আহতদের চিকিৎসায় যাতে ত্রুটি না থাকে আমরা তা দেখছি। মরদেহ দাফনের জন্য প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে,” বলেন তিনি।
একই দিন ভোরে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার বড় হাওরে মাছ ধরার সময় বজ্রাঘাতে দুই জেলের মৃত্যু হয়েছে বলে বেনারকে জানান নিকলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামসুল আলম সিদ্দিকী। ওই ঘটনায় আরো দুইজন আহত হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটে প্রতিদিনই
সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে ২ আগস্ট জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলা দুই জন, মেহেরপুরের মুজিবনগরে একজন, চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে একজন এবং ঝিনাইদহের সদর উপজেলার পণ্ডিতপুর গ্রামে মারা গেছেন একজন। এ ছাড়া ১ আগস্ট মাগুরা সদর উপজেলায় একজন এবং চাঁদপুরে একজনের মৃত্যু হয়।
বজ্রপাত নিয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডার অ্যাওয়ারনেস ফোরাম গত ১১ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ২০২১ সালের মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত চার মাসে বজ্রপাতে ১৭৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে, আহতের সংখ্যা ৪৭। এর মধ্যে শুধু কৃষি কাজ করতে গিয়েই মৃত্যু হয়েছে ১২২ জনের।
“চলতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা না থাকলেও মার্চ মাসের শেষদিন থেকে মৃত্যু শুরু হয়। ফলে মাত্র আড়াই মাসে এতগুলো মৃত্যু হয়েছে,” বলেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রাশিম মোল্লা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মারা গেছেন দুই হাজার ১৬৪ জন। সে হিসেবে গড়ে প্রতি বছর ২৪০ জনের বেশি মানুষ এভাবে প্রাণ হারাচ্ছেন।
গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বজ্রপাতের পরিমাণ ও হতাহতের ঘটনা বাড়ছে বলে জানাচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় দুর্যোগের তালিকায় ২০১৬ সালের ১৭ মে বজ্রপাত অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ ড. আবদুল মান্নান বলেন, বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর–পশ্চিমাঞ্চল বজ্রপাত-প্রবণ এলাকাগুলোর অন্যতম। গ্রীষ্মকালে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকায় এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল এই অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবেই বেশি বজ্রপাত হয়। কারণ উত্তরে পর্বতমালা এবং দক্ষিণে সমুদ্র থাকায় এই অঞ্চলে বজ্রমেঘের সৃষ্টি বেশি হয়।
তিনি বলেন, “বজ্রপাত এড়িয়ে চলাই বজ্রপাত থেকে রক্ষার উপায়। এ জন্য জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড স্থাপন মৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো এভাবে সফলতা পেয়েছে।
তাল গাছের তথ্য নেই
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে চার বছর আগে সারাদেশে ১০ লাখ তালগাছ রোপণের কর্মসূচি নিয়েছিল সরকার। উঁচু স্থানে বজ্রপাত আটকা পড়লে মৃত্যু এড়ানো যায়—এই ধারণার ভিত্তিতে নেওয়া হয় ওই কর্মসূচি। কিন্তু সেই কর্মসূচির বাস্তবায়ন কী পর্যায়ে আছে, সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ ২০১৭ সালের ২৬ জুন বেনারকে বলেছিলেন, “বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে তালগাছ রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বজ্রের আঘাত সাধারণত উঁচু স্থানে হয়ে থাকে। তাল গাছ উঁচু হওয়ায় এটাকেই কার্যকর উপায় হিসেবে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক বেনারকে বলেন, “তালগাছ লাগানোর জন্য দুর্যোগ মন্ত্রণালয় আলাদা কোনো প্রকল্প নেয়নি। কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের অংশ হিসেবে প্রত্যেকের জন্য তালগাছ রোপণের বাধ্যবাধকতা বেধে দেওয়া হয়েছিল।”
“এটা চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু তালগাছ বড়ো হতে অনেক সময় লাগে। বর্তমানে উদ্যোগটি কী অবস্থায় আছে তা আমাদের অ্যাসেস করতে হবে,” জানান তিনি।
তিনি বজ্রপাত নিরোধে সরকারের নতুন কিছু উদ্যোগের কথা তুলে ধরে বলেন, “আমরা হাওর অঞ্চলে ‘লাইটনিং অ্যারেস্টার’ স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছি। পাশাপাশি ‘আর্লি ওয়ার্নিংয়ের’ সর্বশেষ প্রযুক্তি কাজে লাগাতে প্রচেষ্টা রয়েছে।”
মহাপরিচালক জানান, আবহাওয়া অধিদপ্তরের অধীনে ৭-৮টি জায়গায় বজ্রপাত ডিটেকটিভ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। তাতে বিভিন্ন সময়ে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত হচ্ছে। যেসব জায়গায় বেশি বজ্রপাত হচ্ছে সেসব এলাকায় বজ্রপাতনিরোধক প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হবে।