সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা: এক দশকেও তদন্ত শেষ না হওয়ায় উদ্বেগ-হতাশা
2022.02.11
ঢাকা

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পার হলেও তদন্ত শেষ করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। এমনটা দাবি করে শুক্রবার জেনেভা থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের পাঁচ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ।
“বাংলাদেশে ভয়ানক ও ব্যাপক দায়মুক্তির সংস্কৃতি বিরাজ করছে,” উল্লেখ করে তাঁরা বলেছেন, “সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধের বিচার না হলে তা গণমাধ্যমকে ভয় দেখিয়ে চুপ করাতে দোষীদের উৎসাহ দেয় এবং আরো আঘাত, ভীতি ও হত্যাকে ত্বরান্বিত করে। বাংলাদেশে আমরা সেই গভীর উদ্বেগের নিদর্শন দেখতে পাই।”
একইদিন পৃথক বিবৃতিতে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, “এই অমীমাংসিত মামলাটি দায়মুক্তির সংস্কৃতির শক্তিশালী অস্তিত্বের একটি লজ্জাজনক উদাহরণ, যা দেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, যেখানে হত্যাকারীরা মুক্ত থাকে।”
“এটি সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং যেকোনো অপরাধের বিচার করতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয়,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে অগ্রগতি না হওয়া স্পষ্টভাবে সাংবাদিকদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে, রাষ্ট্রের সুরক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং নাগরিকদের সুরক্ষায় রাষ্ট্রের অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।”
জাতিসংঘ ও আর্টিকেল নাইনটিনের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বেনারকে বলেন, “তাঁরা নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বলতেই পারেন। তবে এখানকার প্রেক্ষাপটে তাঁদের চাপে তড়িঘড়ি করে তদন্ত শেষ করার কোনো সুযোগ নেই।”
“এক্ষেত্রে সরকার এবং বিচার বিভাগের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। আমরা শুধু চাই সুষ্ঠু তদন্ত হোক,” যোগ করেন এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।
প্রতিবেদন দাখিল পিছিয়েছে ৮৫ বার
সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ গত এক দশকে মোট ৮৫ বার পিছিয়েছে উল্লেখ করে পিপি জানান, আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন আদালত।
দেশের উচ্চ আদালত ২০১২ সালে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিল, যা এখনো সম্পন্ন হয়নি বলেও জাতিসংঘ ও আর্টিকেল নাইনটিনের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
“আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে পারব,” উল্লেখ করে র্যাবের মুখপাত্র ও আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন শুক্রবার বলেন, “এই মামলা সরকার এতটাই গুরুত্ব দিয়েছে যে, ঘটনাস্থল থেকে জব্দ আলামত যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।”
“বাংলাদেশে কয়টি মামলার তদন্তে বহির্বিশ্বের এমন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে আলামত পাঠিয়েছে, সঠিক আসামি ধরার জন্য?”-এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “র্যাব যখন কোনো মামলার তদন্ত করে তখন তা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে করে থাকে।”
ইতিপূর্বে মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের আলমের অভিযোগ করেছেন, তদন্ত সংস্থার আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। র্যাবের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলার কথাও বলছেন সাগর-রুনির পরিবারের সদস্যরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, “যদিও পরিবার এখনো আমাদের কাছে আসেননি। তবে ব্যপারটা যদি এরকম হয়, তাহলে আদালতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ এখতিয়ার রয়েছে।” তিনি জানান, এই মামলার তদন্তে এখন পর্যন্ত ১৬০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছে র্যাব।
পিপি আবু বলেন, “এটা ঠিক যে র্যাবের তদন্ত শেষ করতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু তাদের ব্যর্থ বলতে পারি না। এই হত্যাকাণ্ডে ‘ক্লু’ খুঁজে পেতে তারা যথেষ্ট আন্তরিকভাবেই তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। তবে এটা দ্রুত শেষ করা দরকার।”
আদালত সূত্রে জানা গেছে, সাগর-রুনি হত্যা মামলাটির তদন্তভার প্রথমে পান শেরে বাংলানগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জহুরুল ইসলাম। এরপর ২০১২ সালের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলম তদন্ত শুরু করেন।
হাইকোর্ট বিভাগের এক রিট পিটিশনে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল মামলার তদন্তভার র্যাবের কাছে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর ১৯ এপ্রিল র্যাব সদর দপ্তরের সিনিয়র পুলিশ সুপার মো. জাফর উল্লাহ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। তিনি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়ার কারণে ২০১৪ সালের ১২ মার্চ তদন্তভার পান র্যাব সদর দপ্তরের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. ওয়ারেছ আলী মিয়া।
এরপর র্যাব সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহম্মেদ ২০১৫ সালে তদন্তভার গ্রহণ করেন এবং সর্বশেষ মামলাটি র্যাব সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শফিকুল ইসলাম তদন্ত করছেন।
দুর্নীতির অনুসন্ধানই হত্যার কারণ!
জাতিসংঘরে মানবাধিকার কাউন্সিলের বিশেষজ্ঞ আইরিন খান, মেরি ললর, ক্লেমেন্ট এন ভউল, নিলস মেলজার এবং মরিস টিডবল-বিঞ্জ উল্লেখিত বিবৃতিতে বলেন, “ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, বাংলাদেশের জ্বালানী খাতের দুর্নীতির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে কার্যক্রম ও তা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণের কারণেই এই দম্পতি লক্ষ হন।”
“২০১২ সালে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের পাঠানো চিঠির কোনো জবাব সরকারের কাছ থেকে কখনোই পাওয়া যায়নি,” উল্লেখ করেন তারা।
আর্টিকেল নাইনটিন বলেছে, ২০২১ এর ২ মার্চে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে হলফনামা আকারে জমা দেয়া র্যাবের একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায় যে, দুই অজ্ঞাত ব্যক্তি এই হত্যার সাথে জড়িত ছিল।
এ হত্যাকাণ্ডের বিচার না দেখেই চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি মারা গেছেন মেহেরুন রুনির মা নুরুন নাহার মির্জা।
নিহত সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির স্থানীয় একাধিক গণমাধ্যমকে বলেছেন, “সরকার ইচ্ছা করলে সব কিছুই করতে পারে। আমি জীবদ্দশায় (বিচার) দেখে যেতে চাই। রুনির মা তো পারেনি, আমি দেখে যেতে চাই, ছেলের কবরটা জিয়ারত করতে চাই।”
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় পাঁচ বছরের ছেলের সামনে নির্মমভাবে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি।
পরদিন ভোরে তাঁদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চায় ডিআরইউ
সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তের জট খুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ দাবি করেছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)। ডিআরইউ চত্বরে শুক্রবার এক প্রতিবাদ সমাবেশে এ দাবি জানানো হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিআরইউ সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু বেনারকে বলেন, “বারবার ব্যর্থ হচ্ছে তদন্ত কর্মকর্তারা। এ জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছি আমরা।”
ডিআরইউ আগামী রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি দেবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
গত এক দশকে বাংলাদেশে অন্তত ১৫ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন উল্লেখ করে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, “এসব ঘটনার তদন্ত বা বিচার খুব কমই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে মনে করা হয়।”