বাংলাদেশে বেনারনিউজ ওয়েবসাইট বন্ধ: স্বীকার করলেন সরকারি কর্তৃপক্ষ

বেনারনিউজ স্টাফ
2020.04.03
ওয়াশিংটন ডিসি
200403-BD-update-620.JPG করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় জনসমাগম এড়াতে সরকার ঘোষিত বাধ্যতামূলক সাধারণ ছুটিতে ঢাকার রাস্তায় পুলিশের নজরদারি। ১ এপ্রিল ২০২০।
[রয়টার্স]

আপডেট: ৩ এপ্রিল ২০২০ইস্টার্ন সময় বিকেল ০৫.১০

সম্প্রতি বাংলাদেশে বন্ধ করে দেয়া কয়েকটি ওয়েবসাইটের মধ্যে বেনারনিউজও থাকতে পারে বলে শুক্রবার স্বীকার করেছেন সরকারের একজন মন্ত্রী। ধারণা করা হচ্ছে, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় সরকারের সমালোচনার দায়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে অভিযানের ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার থেকে বাংলাদেশের পাঠকরা বেনারনিউজ দেখতে পাচ্ছেন না।

বেনারনিউজ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত বেসরকারি ও অলাভজনক গণমাধ্যম রেডিও ফ্রি এশিয়ার (আরএফএ) একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান, যা এশিয়ার পাঠকদের জন্য সেন্সরবিহীন তথ্য ও সংবাদ পরিবেশন করে থাকে।

বেনারনিউজের ইংরেজি ও বাংলা কোনো সাইটই বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বাংলাদেশের পাঠকরা দেখতে পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন।

“গুজব ও মিথ্যা তথ্য প্রচারের দায়ে” কয়েকটি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেবার কথা জানালেও বেনারনিউজ ব্লক করার বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলেননি সরকারি কর্মকর্তারা।

বেনার কেন বন্ধ করা হয়েছে তা দ্বিতীয়বারের মতো শুক্রবার জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার ওয়েবসাইটটি খোলার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

“বেনারনিউজ ব্লক করা হলে তা নির্দিষ্ট কোনো কারণেই করা হয়েছে,” মন্তব্য করে মোস্তফা জব্বার ঢাকায় বেনার প্রতিবেদককে বলেন, “আপনি বরং তাদেরকে বিটিআরসির কাছে তা খুলে দেয়ার আবেদন করতে বলেন।”

করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর মোট কতটা সাইট বন্ধ করা হয়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “আসলে, মিথ্যা তথ্য ও গুজব রটানোর জন্য আমরা কিছু সাইট বন্ধ করেছি। খুব কম সংখ্যক সংবাদ মাধ্যমের সাইট বন্ধ করা হয়েছে।”

বেনার ওয়েবসাইট সম্পর্কে জানতে বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হকের সাথেও দ্বিতীয়বারের মতো যোগাযোগ করা হলে তিনি “সাইট বন্ধ করা একটি চলমান প্রক্রিয়া” মন্তব্য করে শুক্রবার বেনারকে জানান “আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারব না বেনারনিউজ বন্ধ করা হয়েছে কি না।”

তিনি বলেন, “তবে সাইট বন্ধ করতে হলে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, টেলিযোগাযোগ উপদেষ্টা, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবসহ আরও দুই শীর্ষ কর্মকর্তার অনুমোদন প্রয়োজন হয়।”

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলার কৌশল নিয়ে সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোরতা প্রদর্শন করছে বলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের চলতি সপ্তাহের সমালোচনার পরপরই বেনারনিউজ ওয়েবসাইটটি বন্ধের ঘটনা ঘটল।

স্থানীয় এক গণমাধ্যমের বিশ্লেষণী প্রতিবেদন মতে, ১৬ কোটির বেশি মানুষের বাংলাদেশে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় সরকারের করোনাভাইরাস রোগ নির্ণয়ের জন্য নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ প্রায় সর্বনিম্ন।

বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শুক্রবারে শনাক্ত পাঁচ জনসহ এ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৬১ জন, মারা গেছেন ছয়জন।

বেনারনিউজ কঠোরভাবে সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে “দায়িত্বশীল প্রতিবেদন” প্রকাশ করে থাকে বলে জানান গণমাধ্যমটির ম্যানেজিং এডিটর কেইট বেডাল।

“প্রতিটি প্রতিবেদনকে যথাযথ তথ্যনির্ভর ও সামাঞ্জস্যপূর্ণ করার ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবেদক ও সম্পাদকেরা খুবই সতর্ক থাকেন,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে যখন করোনাভাইরাস মহামারি সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের সময়োপযোগী ও নির্ভযোগ্য তথ্য খুব জরুরি, সেই মুহূর্তে একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমকে ব্লক করে দেয়া মানে সরাসরি তাঁদের ক্ষতি করা।”

বেশ কিছু ওয়েবসাইট বন্ধ

বাংলাদেশে বেনারনিউজ বন্ধ হবার পর বৃহস্পতিবার টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তাঁর মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিটিআরসি সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট বন্ধ করেছে।

তবে ওই সাইটগুলোর মধ্যে বেনারনিউজ রয়েছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানাননি তিনি।

করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ৫০টি অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে বিটিআরসিকে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানায় পুলিশ সদরদপ্তর।

এছাড়া সামাজিক মাধ্যমের আরো ৮২টি অ্যাকাউন্ট, পেইজ ও সাইটে গুজব ছড়ানোর পেছনের মানুষদের খুঁজে বের করতে অনুসন্ধান চলছে বলেও বিবৃতিতে জানায় পুলিশ।

গুজব ছড়ানোর অভিযোগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, গুজবের সাথে সম্পৃক্তদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহত থাকবে।

প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে বিশ লাখ পর্যন্ত মানুষ মারা যেতে পারে বলে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া জাতিসংঘের একটি খসড়া নথিতে আশঙ্কা করা হয়।

সুইডেন ভিত্তিক নিউজপোর্টাল নেত্র নিউজ জাতিসংঘের ‘কান্ট্রি প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স প্লান’ শীর্ষক ফাঁস হওয়া ওই নথিটির ওপর ভিত্তি করে গত শনিবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

বাংলাদেশে কর্মরত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, সরকার, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে ওই নথিটি তৈরি করেছে বলে নেত্র নিউজকে জানান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঢাকা অফিসের প্রধান বর্দান জাং রানা।

খসড়া ওই নথিটি গত সপ্তায় ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের কাছে বিতরণ করা হয়েছে বলেও জানায় নেত্র নিউজ।

ওই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে গত মঙ্গলবার বেনারনিউজও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ফাঁস হওয়া জাতিসংঘের ওই নথিটি দেখেছেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন। তবে “এ ধরনের নথি প্রকাশ করা জাতিসংঘ সনদের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন,” বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বেনারকে বলেন, “আইনানুযায়ী, জাতিসংঘ এরকম কোনো নথি প্রচার করার আগে আমাদের সরকারের সাথে আলোচনা করার কথা। আমরা সম্মতি দিলে তবেই তারা প্রচার বা বিতরণ করতে পারে।”

এদিকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের কৌশল নিয়ে সমালোচনা করার দায়ে ডাক্তার, বিরোধী দলীয় সদস্য ও ছাত্রসহ অন্তত এক ডজন মানুষকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানায় মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

বিবৃতিতে সংস্থাটির এশীয় অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, “কোভিড-১৯ নিয়ে কোনো মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হলে তা বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারের রয়েছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, যারা এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করবেন অথবা এই সংকট মোকাবেলার ব্যাপারে সরকারের কৌশল নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করবেন তাঁদের স্তব্ধ করতে হবে।”

তিনি বলেন, “এই অবস্থায় সরকারের উচিত মানুষের মত প্রকাশের অধিকার খর্ব না করে বরং এই ভাইরাস প্রতিরোধ, দমন ও এর চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা জানিয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করা।”

তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনারকে বলেন, “আমরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই প্রতিবেদন প্রত্যাখান করি। সরকার করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ব্যস্ত। কারো মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।