কারামুক্ত প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.04.03
ঢাকা
কারামুক্ত প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জামিন পেয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে শামসুজ্জামান শামস (মাঝখানে) দৈনিক প্রথম আলোর কার্যালয়ে এলে সহকর্মীরা তাঁকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। ৩ এপ্রিল ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

কারামুক্ত হয়েছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস।

সোমবার নিম্ন আদালত থেকে জামিন পেয়ে সন্ধ্যা ৬টার পরে শামসুজ্জামান কেরানীগঞ্জ কারাগার থেকে বাইরে আসেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন তাঁর আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার।

আওয়ামী লীগ সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং সরকার এই স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করতে চায় না—রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্যের পরদিনই জামিন মিলল শামসুজ্জামানের।

এর আগে রোববার বিকেলে উচ্চ আদালত থেকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন পেয়েছেন প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশক মতিউর রহমান।

বৃহস্পতিবার রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মতিউর রহমান, শামসুজ্জামান ও তাঁর সহকারী ক্যামেরাপারসন এবং অজ্ঞাতনামা আরো কয়েকজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা আব্দুল মালেক মশিউর মালেক। ওই মামলায় শামসুজ্জামানকে কারাগারে পাঠায় আদালত। মামলায় সম্পাদক মতিউর রহমানকে পলাতক দেখানো হয়।

রমনা থানায় মামলা দায়েরের আগেই বুধবার প্রথম প্রহরে সাভারের ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে শামসুজ্জামানকে তুলে নিয়ে আসে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। যদিও দুপুর পর্যন্ত ‘তাঁকে রাতের আঁধারে তুলে আনার’ বিষয়টি অস্বীকার করে পুলিশ।

বুধবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান শামসুজ্জামানের আটকের তথ্য নিশ্চিত করে জানান, তেজগাঁও থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলায় শামসুজ্জামানকে আটক করা হয়েছে।

শুভবুদ্ধির উদয়

প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রতিবেদকের জামিন পাওয়াকে ‘ইতিবাচক’ ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান।

সোমবার তিনি বেনারকে বলেন, “এই প্রতিবেদকে রাতের আঁধারে বিনা গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় আটকের ফলে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল।”

“তবে আমার মনে হয়, এই প্রতিক্রিয়ার কারণে সরকারের উচ্চ মহলে বিষয়টি নিয়ে হয়তো সিরিয়াসলি চিন্তা-ভাবনা করা হয়েছে বিধায় জামিন হয়েছে। আমি বলবো, সবার মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে,” বলেন তিনি।

মিজানুর রহমান বলেন, “সম্পাদক ও প্রতিবেদকের জামিন দেওয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগ সরকারকে একটি বার্তা দিয়েছে। বার্তাটি হলো; প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও সম্পাদকের বিষয়ে যা করা হয়েছে সেটি সঠিক হয়নি। এটি বাড়াবাড়ি হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে বিনা গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় আটক করা যাবে না। এছাড়া, এক ব্যক্তিকে কীভাবে আটক করতে হবে সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সেই নির্দেশনা লঙ্ঘিত হয়েছে। আমার মনে হয়, আদালত বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি।”

মিজানুর রহমান বলেন, “এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে সরকারও গণমাধ্যমকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছে এবং আমি মনে করি, সরকারের কথা পুরোপুরি ভুল নয়।”

তিনি বলেন, “একজন শিশুকে তার পিতা-মাতার সম্মতি ও উপস্থিতি ছাড়া সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরা যায় না। এটি আমাদের সাংবাদিকরা হয়তো সব সময় অনুসরণ করেন না। এই ঘটনা থেকে সাংবাদিকরা তাঁদের পেশাগত কাজে আরও বেশি মনোযোগী এবং সতর্ক হবেন, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।”

জাতিসংঘের উদ্বেগ

প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের এবং পত্রিকাটির সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে কারাগারে পাঠানোয় শুক্রবার জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি প্রদান করেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনসহ অনলাইনে সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহৃত হওয়ায় তিনি উদ্বিগ্ন।

হাইকমিশনার টুর্ক এই আইন অবিলম্বে স্থগিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকরের পর থেকে এই আইনে পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি মামলা হয়েছে।

তবে এই আইন কোনোক্রমেই বাতিল হবে না বলে বেনারকে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারা সংশোধন করা যেতে পারে।”

যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে

মামলার এজাহারে আব্দুল মালেক অভিযোগ করেছেন, ২৬ মার্চ ফেসবুক ব্যবহার করার সময় ছড়িয়ে পড়া (ভাইরাল) একটি প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট তিনি দেখতে পান।

স্ক্রিনশটে প্রথম আলোর প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের করা একটি প্রতিবেদন দেখতে পান, যার শিরোনাম ছিল “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবে।”

তবে প্রতিবেদনের নিচে জাকির হোসেন, দিনমজুর, সাভার লেখা থাকলেও ছবি দেওয়া হয়েছে একটি ফুল বিক্রেতা শিশুর।

অভিযোগকারী উল্লেখ করেন, ২৭ মার্চ একাত্তর টিভির এক প্রতিবেদনে তিনি জানতে পারেন যে, কথিত জাকির নামে শিশুটির নাম সবুজ।

একাত্তর টিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিশুটিকে ১০ টাকা দিয়ে তার ছবি তোলা হয়েছে এবং শিশুটি প্রথম আলোর কাছে কোনো বক্তব্য দেয়নি, উল্লেখ করা হয় এজাহারে।

এজাহারে বলা হয়, “প্রথম আলোর প্রতিবেদক শামসুজ্জামান ও সম্পাদক দেশের মহান স্বাধীনতা সম্পর্কে জনমনে বীতশ্রদ্ধ সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বর্তমান শান্তিময় পরিস্থিতি বিঘ্নিত করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করাসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার হীন চেষ্টা করেছেন। এর ফলে দেশের জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে, দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার উপক্রম হয়েছে।”

এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা রেকর্ড করে রমনা থানা। মামলা দায়ের প্রতিবেদককে গ্রেপ্তার ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার ঘটনায় দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়।

প্রথম আলোর পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন পেশাজীবী ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা বক্তব্য দিচ্ছেন।

সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসের বাসায় গিয়ে সোমবার তাঁর মাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন বিএনপি নেতারা। এ সময় শামসুজ্জামানের মা করিমন নেসা কান্নায় ভেঙে পড়েন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।