লিবিয়ায় আটক সোয়া পাঁচশ’র বেশি বাংলাদেশি: ফিরতে রাজি অর্ধেক
2022.04.27
ঢাকা

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপ যাত্রার সময় লিবিয়ায় আটক সোয়া পাঁচশ’র বেশি বাংলাদেশির মধ্যে প্রায় অর্ধেক মে মাসের শেষের দিকে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন লিবিয়াতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল এস এম শামিম-উজ জামান।
বর্তমানে তাদেরকে তারিক আল মাতার নামে একটা ডিটেনশন সেন্টারে এনে রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
“লিবিয়ার উপকূলে গত শনিবার একটি নৌযান থেকে ৫২৮ জন বাংলাদেশিকে আটক করা হয়। আটক হওয়া বেশিরভাগ বাংলাদেশির বয়স কুড়ি থেকে বাইশ বছর। আমরা এ পর্যন্ত ৪১০ জনের সঙ্গে কথা বলে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছি,” বুধবার টেলিফোনে বেনারকে বলেন শামিম-উজ-জামান।
অনেকে দূরবর্তী ক্যাম্পে অবস্থান করার কারণে এখনও বাকিদের সঙ্গে কথা বলা যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের মধ্যে ২৪৪ জন দেশে ফিরতে রাজি হয়েছেন।”
“আমরা আশা করছি, মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তায় তাদেরকে দেশে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে,” জানান রাষ্ট্রদূত।
বাকিদের বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত জানান, বাকিরা বাংলাদেশে ফিরতে চান না। ঋণ করে বিদেশ আসার কারণে তারা যেকোনো মূল্যে বিদেশে থেকে আয় উপার্জন করতে চান। আর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের নিয়ম অনুযায়ী জোর করে ফেরত পাঠাতে পারে না।
“তবে এখানে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই জানিয়ে বাংলাদেশি দূতাবাস কর্মকর্তারা তাদের এখন বুঝিয়ে সম্মত করার চেষ্টা করছেন,” বলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।
ত্রিপলির বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানায়, গত শনিবার লিবিয়ার উপকূলে একটি নৌযান থেকে ৫ শতাধিক বাংলাদেশিসহ ৬০০ ব্যক্তিকে দেশটির কোস্টগার্ড আটক করে। তাঁদেরকে লিবিয়ার ত্রিপলির একটি ডিটেনশন সেন্টারে নেওয়া হয়।
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসন প্রত্যাশীরা। ফলে প্রতিবছরই লিবিয়ার উপকূল থেকে বাংলাদেশিদের আটক করার ঘটনা ঘটছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ২০১৬ সালে এক দিনে ছয় শতাধিক অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। সে বছরের মার্চে লিবিয়ার পশ্চিম উপকূলে ৪টি নৌকা থেকে ৬০০ ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়; যাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই বাংলাদেশি ছিলেন। ওই বছরে পরে একদিনে এত বাংলাদেশিকে আটকের ঘটনা এটাই প্রথম।
উন্মুক্ত হয়েছে লিবিয়ার শ্রমবাজার
বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য সম্প্রতি লিবিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, দেশটি দক্ষ শ্রমিক নিচ্ছে। আরো নেবে। এ অবস্থাই আমরা চাই ইউরোপে যাওয়ার নামে এমন অবৈধ, অমর্যাদাকর বিপজ্জনক যাত্রা সবার আগে বন্ধ হোক।
আটক বাংলাদেশিদের ফেরত আনা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আইওএমের নবনিযুক্ত চিফ অব মিশন আবদুসাত্তর এসোয়েভ মঙ্গলবার দেখা করে আমাকে বলেছেন, লিবিয়া থেকে ফেরত আনা বাংলাদেশিদের অনেকেই আবারও একই পথ অবলম্বন করেন। এটা বন্ধ করা দরকার।
এ বিষয়ে সরকার কঠোর অবস্থান নেবে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
রাষ্ট্রদূত শামিম-উজ-জামান জানান, ২০১৫ সাল থেকে লিবিয়ায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ ছিল। তবে এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাজারটি উন্মুক্ত হওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এরপর চলতি মাসে আট জন বাংলাদেশি দেশটিতে যান।
“এরা সবাই দক্ষ শ্রমিক। উচ্চ বেতন নিয়ে এখানকার তেলক্ষেত্রে কাজ করছেন। এই আটজনের মধ্যে ছয়জন নতুন বাকি দুজনের আগে লিবিয়াতে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে,” বেনারকে বলেন তিনি।
বৈধভাবে কর্মী আসা বাড়লে অবৈধপথে কর্মী আসা বা মানবপাচার কমবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে সচেতন করা এবং সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মত দেন রাষ্ট্রদূত।
রাষ্ট্রদূত জানান, বর্তমানে দেশটিতে আসলেই কতজন বাংলাদেশি রয়েছেন সেটা বলা মুশকিল। কারণ দেশটির রাজনৈতিক অবস্থা অস্থিতিশীল থাকার কারণে কেউই স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারে না। তাই সঠিক সংখ্যাটা জানা কঠিন। তবে দুই হাজারের মতো বাংলাদেশিকে দূতাবাস ডিজিটালি নানা ধরনের সেবা দিয়ে থাকে।
অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার অন্যতম রুট হিসেবে অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রথম গন্তব্য থাকে ইতালি এবং গ্রীস উপকুল, এর পরেই লিবিয়া। লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তারা ইউরোপের দেশগুলোতে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন।
ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বিভিন্ন সময় নৌকাডুবিতে মৃত্যু ও মানব পাচারকারীদের হাতে জিম্মি হওয়ার ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার সময় শীতে জমে সাতজন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়।
এর আগে ২০২০ সালে ২৮ মে লিবিয়ার প্রত্যন্ত মিজদা অঞ্চলে ৩৮ জন বাংলাদেশি মানব পাচারকারীদের কাছ থেকে অপহরণের শিকার হন। পরে অপহরণকারীদের গুলিতে ২৬ জন বাংলাদেশি নিহত হন। আহত হন আরও ১১ জন।
ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বেনারকে বলেন, “ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপ প্রবেশের চেষ্টার প্রবণতা বেশি কয়েকটা জেলায়। এদের মধ্যে রয়েছে শরিয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
“এক্ষেত্রে যুদ্ধ বিধ্বস্ত আরব দেশ কিংবা আফ্রিকার দারিদ্রপীড়িত দেশগুলোর নাগরিকদের সাথে বাংলাদেশিদের নাম যুক্ত হচ্ছে। যা দুঃখজনক,” বলেন তিনি।
“বিদেশ গেলেই টাকা আসবে এমন ভাবনা থেকেই তারা ৫-১০ লক্ষ টাকা খরচ করে এই পথ বেছে নিচ্ছে। অনেক সময় ইউরোপে থাকা বন্ধু বা স্বজনরাই তাঁদের পথ দেখান। এই পথ বিপদজনক জেনেও তাঁদের পরিবার ও স্বজনেরা টাকা যোগাড় করে দেন,” বলেন শরিফুল হাসান।