সৌদি গিয়ে গৃহকর্তার সন্তান নিয়ে দেশে ফিরলেন নারী শ্রমিক
2021.06.09
ঢাকা

ছয় মাসের ছেলে সন্তান নিয়ে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে লজ্জায় পরিবারের কাছে ফিরতে পারছেন না ৩২ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি নারী।
গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সেখানে নিয়োগকর্তার কাছে নিয়মিত যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার এক পর্যায়ে ওই সন্তানের জন্ম হয়। ফলে লজ্জায় বাড়িতে না গিয়ে ওই শিশু সন্তানকে নিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের লার্নিং সেন্টারে। ওই নারী যে দেশে ফিরেছেন তা পরিবারও জানে না।
সন্তানসহ ওই নারী মঙ্গলবার সকালে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান।
তাঁর বরাত দিয়ে বিমানবন্দরে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান জানান, সৌদি আরবে যে বাড়িতে ওই নারী কাজ করতেন, সেই গৃহকর্তা তাঁর সন্তানের বাবা।
তিনি বলেন, “ওই নারী জানিয়েছেন, বিষয়টি তাঁর পরিবারের কেউ জানে না। এই সন্তান নিয়ে তিনি পরিবারে ফিরতে পারবেন না। পরিবার ও সমাজ বিষয়টি ভালোভাবে নেবে না।”
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য কর্মকর্তা আল আমিন নয়ন বেনারকে জানান, সন্তান নিয়ে বিমানবন্দরে নেমে কোথায় যাবেন, সে বিষয়ে কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে ওই নারী বিষয়টি বিমানবন্দর আর্মড পুলিশকে জানান। এরপর সেখান থেকে তাঁকে ব্র্যাকের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সন্তানসহ ওই নারী বর্তমানে ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে অবস্থান করছেন বলে জানান তিনি। ব্যক্তিগত সুরক্ষার স্বার্থে বেনারনিউজ ওই নারীর নাম–ঠিকানা বা অন্য কোনো তথ্য প্রকাশ করছে না।
নয়ন জানান, দুই সন্তান রেখে ওই নারী বিদেশে গিয়েছিলেন। এখন তিনি চান এই সন্তানটি কোনো পরিবারের কাছে দত্তক দিয়ে বাড়িতে ফিরতে।
“এই ধরনের ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত,” বেনারকে বলেন শরিফুল হাসান।
“সৌদি আরবের কোন বাড়িতে তিনি কাজ করতে গিয়েছিলেন, তাঁর নিয়োগকর্তা কে—এগুলোর তদন্ত হওয়া উচিত। প্রয়োজনে ডিএনএ টেস্ট করে সন্তানের পিতৃ পরিচয় বের করা উচিত,” যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমাদের প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ এখন শিশুটিকে সুস্থ রাখা এবং ওই নারীকে সমর্থন দেওয়া। তারপরে আমরা তাঁকে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।”
এর আগে এই ধরনের ১২টি ঘটনার কথা উল্লেখ করে ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান বলেন, “আমরা তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা যেন না ঘটে সে বিষয়ে আমাদের সোচ্চার ও নীতি নির্ধারকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।”
ব্র্যাকের তথ্যকেন্দ্র থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের নভেম্বরে ওই নারী সৌদি আরব যান। দেশে ফেরা ওই নারী জানান, সেখানে যাওয়ার পর থেকেই প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হতেন। একপর্যায়ে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হলে তাঁকে সফর জেলে পাঠানো হয়। সেখানেই জন্ম হয় শিশুটির।
দূতাবাসের ভূমিকায় প্রশ্ন
সৌদি আরবে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ বেনারকে বলেন, “এ ধরনের ঘটনা অবশ্যই দুঃখজনক। তবে এসব ক্ষেত্রে অপরাধী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা থেকে শুরু করে ভুক্তভোগীর ক্ষতিপূরণ আদায় করা পর্যন্ত দূতাবাসের বড়ো ধরনের ভূমিকা আছে।”
নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে মামলা বা আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে এই নারীকে দূতাবাস কীভাবে ফেরত পাঠালো—সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “সফর জেলে থাকলেও সেখানে প্রতিদিন আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তারা পরিদর্শনে যান। দূতাবাসের অ্যাপ্রুভাল ছাড়া ওই নারী নিজ পাসপোর্টে সন্তান নিয়ে ফিরতে পারেন না। সুতরাং দূতাবাসের উচিত ছিল আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।”
সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে এ ধরনের তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে গোলাম মসীহ বলেন, “এখন সৌদি আরবের আইন বদলেছে। নিয়োগকর্তা দোষী হলে অবশ্যই তিনি শাস্তি পাবেন। তাই অবশ্যই এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।”
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বেনারকে বলেন, “খবরটি পত্রিকায় পড়েছি। এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এ ধরনের নির্যাতনের নিন্দা জানাই।”
“মেয়েটির হয়ে আইনি লড়াই কীভাবে করা যায় সে বিষয়ে পদক্ষেপের পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সে বিষয়ে সৌদি আরবের সাথে আলোচনা করা হবে,” বলেন শহীদুল আলম।
সৌদি ফেরত ৩৫ ভাগ নারী নির্যাতনের শিকার
যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব থেকে ফেরার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে গত ২৬ মার্চ সৌদি আরব থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সন্তান নিয়ে দেশে ফিরেছেন নরসিংদী জেলার বেলাবো উপজেলার কুমারী শাহনাজ আক্তার (২৭)। শাহনাজ সৌদি আরবের মক্কাস্থ কেন্দ্রীয় জেলে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় পুত্র সন্তান জন্ম দেন।
এর আগে গত ২ এপ্রিল নিজের আট মাসের শিশু সন্তানকে বিমানবন্দরে ফেলেই চলে যান সৌদি ফেরত আরেকজন মা।
এ বছরে ২৪ ফেব্রুয়ারি সাথী আক্তার নামের আরেক নারী গৃহকর্মী চার মাসের মেয়ে সন্তান নিয়ে ওমান থেকে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর সাথী আক্তার এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ অফিসে গিয়ে বলেন, তাঁর সন্তানের পিতা একজন ওমানি নাগরিক।
এর আগে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর ওমান থেকে হবিগঞ্জ জেলার গুলজাহান বেগম নামের আরেক গৃহকর্মী তিন মাস বয়সী সন্তানসহ দেশে ফিরতে বাধ্য হন।
২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের উপস্থাপন করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরব থেকে ফেরা নারী গৃহশ্রমিকদের প্রায় ৩৫ শতাংশ সেখানে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। আর ৪৪ শতাংশ নারীকে নিয়মিত বেতন–ভাতা দেওয়া হতো না।
ওই বছরের ২৬ আগস্ট সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরা ১১০ জন নারীর ওপর জরিপ চালিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
বিএমইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিদেশে যান এক লাখ চার হাজার ৭৮৬ জন বাংলাদেশি নারী। এর মধ্যে সৌদি আরবে গেছেন ৬২ হাজার ৫৭৮ জন।
ব্যুরোর তথ্য বলছে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৯ লাখ ২ হাজার ৪৮১ জন নারী কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরবে গেছেন ৩ লাখ ৪১ হাজার ২০ নারী কর্মী।