সৌদি থেকে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরলেন ১৪ নারী কর্মী
2021.08.13
ঢাকা

“স্বামী দিনমজুর, চার সন্তান। সংসার চলত না। তাই পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করে সৌদি আরব গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমাদের ভাগ্যটা বদলাবে। কিন্তু তিন মাসের বেতন বাকি রেখেই দেশে ফিরতে হলো। এখন বিমানবন্দর থেকে গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাড়ি ফিরব সেই টাকাও নেই,” বেনারকে বলছিলেন সুনামগঞ্জের রাশিদা বেগম (২৬)।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের বহির্গমন গেটের বাইরে শুক্রবার বিকেলে কথা হয় রাশিদার সঙ্গে। রাশিদার মতোই শুক্রবার সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন আরো ১৩ জন নারী কর্মী। রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেইফ হাউজে ছিলেন তাঁরা। ফিরে আসা ছয় নারী কর্মীর সাথে কথা হয়ে বেনার প্রতিবেদকের।
প্রায় আড়াই বছর আগে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি গিয়েছিলেন রাশিদা। নিজের ব্যবহার করা কয়েকটি কাপড় আর একটি কম্বল নিয়ে শুক্রবার বিকেলে দেশে ফিরেছেন তিনি। বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন স্বামীর জন্য। সেই অপেক্ষার ফাঁকে কথা হয় তাঁর সাথে।
“১০০০ রিয়াল (প্রায় ২০ হাজার টাকা) বেতন পেতাম। প্রথম কয়েক মাস বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারতাম। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হলে বেতন প্রথমে কমল, এরপর বন্ধ হলো। শেষমেশ তিন মাসের বেতন বাকি রেখেই আমাকে দেশে ফিরতে হলো,” বলেন রাশিদা।
“আবার কাজের অতিরিক্ত চাপও ছিল। মালিকের পাঁচটি সন্তান সামলাতে হতো। রান্নাসহ বাড়ির সব কাজ করতাম। এরপর মালিকের মাদ্রাসা ঝাড়ু দিতে হতো,” বলেন তিনি।
শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে রাশিদা বলেন, ঘরে–বাইরে কাজে একটু ভুল হলেই মারধর করত। ঠিকমতো খেতেও দিতো না। তাই ভাবলাম এভাবে কষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
বিকাল চারটায় বিমানবন্দরে এই প্রতিবেদকের মোবাইল ফোন থেকে স্বামী নজরুল ইসলামকে ফোন করেছিলেন রাশিদা। প্রায় সাত ঘন্টা পর রাত এগারোটায় জানা যায়, বিমানবন্দরেই অবস্থান করছেন ওই নারী। তাঁর কাছে মোবাইল ফোন নেই।
রাত এগারোটায় দিনমজুর নজরুল ইসলাম ফোন করেন এই প্রতিবেদকের মোবাইলে। তিনি জানান, বিমানবন্দরে পৌঁছাতে তাঁর আরও এক ঘন্টা লাগবে।
এক প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম জানান, “স্ত্রী কখন ঢাকায় নামবে তা আগে জানায়নি। বলেছিল সন্ধ্যার দিকে আসবে। আমি সুনামগঞ্জ থেকে দুপুরের দিকে রওনা দেই। রাত বারোটায় হয়তো পৌঁছাতে পারব।”
নজরুল আরও জানান, তাঁর স্ত্রীর কাছে বাসের টিকিট কেটে বাড়ি যাওয়ার মতো টাকা নেই। তিনি বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর টিকিট কেটে বাড়ি ফিরবেন।
ফিরে আসা আরেক নারী দিনাজপুরের শেফালি বেগম (৩৬)। বেনারকে তিনি বলেন, “দিনরাত পরিশ্রম করতাম। কিন্তু মাসের পর মাস বেতন পাইনি। তাই একদিন মালিকের বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নেই। সেখানে দীর্ঘ ছয় মাস কাটিয়েছি। সেখান থেকে আউট পাস নিয়ে খালি হাতেই দেশে ফিরলাম।”
দূতাবাসের সেইফ হোমে রয়েছেন আরো ১৬১
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এসব কর্মী ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডের অর্থায়নে দূতাবাস পরিচালিত সেইফ হোমে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের বোর্ডের সহায়তায় দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। দূতাবাসের সেইফ হোমে এখনও আরো ১৬১ জন নারী কর্মী রয়েছেন বলে বেনারকে জানান ফিরে আসা তিন নারী কর্মী। এতদিন তারা সবাই একসঙ্গেই ছিলেন।
এ বিষয়ে সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে শুক্রবার কয়েক দফা চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকায় মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌদি আরব ছাড়াও করোনাকালে চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরা শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ থেকে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে নানামুখী সমস্যায় পড়া দুই হাজার ৭৬৯ জন নারী আউট পাসের মাধ্যমে দেশে ফিরেছেন। এ ছাড়া ২০২০ সালে আউট পাস ও পাসপোর্ট নিয়ে ফিরেছেন ৫০ হাজার ৬১৪ জন নারী শ্রমিক।
প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস মহামারিকালে গত বছরের এপ্রিল থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু সৌদি আরব থেকেই ফিরেছেন এক লাখ ১৯ হাজার ১৭২ জন। এদের মধ্যে নারী ২১ হাজার ২৩০ জন। তাঁদের বড়ো একটি অংশ কাজ হারানো, বেতন না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে আউট পাশ নিয়ে দেশে ফেরেন।
নারায়ণগঞ্জের মমতা বেগমও (৩৫) ফিরলেন ১৪ জনের দলে। মমতা বেনারকে বলেন, সৌদিতে যাওয়ার দুবছর কিছুটা ভালো ছিলাম। এরপর আমার আকামার (কাজের অনুমতি) মেয়াদ শেষ হলে কফিল (নিয়োগকর্তা) তা আর বাড়ায়নি। কিন্তু যে টাকা খরচ করে গিয়েছি, তাও ওঠাতে পারিনি।
“কাজ না থাকলে বিদেশে বসে কী করব? খুব কষ্টে দিন পার করছিলাম। একদিন আমি দূতাবাসে গিয়ে আশ্রয় নেই। তাদের সহায়তায় দেশে ফিরেছি,” বলেন মমতা।
বিদেশ ফেরত নারীদের সংকট বেশি
সংশ্লিষ্টদের মতে, সৌদি আরবে প্রায় ১৫-২০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে। তাঁদের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ নারী।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বেনারকে বলেন, “স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কোভিডকালে অনেক বেশি কর্মী ফেরত আসছে। অন্য সময় বছরে ৫০-৬০ হাজার কর্মী ডিপোর্ট হন (ফিরে আসেন)।”
“সেখানে গত বছরেই কোভিডকালে চার লাখ আট হাজার কর্মী ফিরে এসেছেন, যার মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি নারী। এ বছরেও ফেরা অব্যাহত রয়েছে। এদের বড় একটি অংশ বেতন না নিয়ে ফিরতে বাধ্য হয়েছে,” বলেন তিনি।
“বলা যায়, গত ১০ বছরে যত কর্মী ফেরেনি গত এক বছরে তত কর্মী ফেরত এসেছেন,” বলেন ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান।
এটি বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতের জন্য অশনি সংকেত উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিদেশ থেকে যারা ফিরছেন তাঁদের জন্য অনেক পরিকল্পনাই হচ্ছে। তবে তাঁদের পুনর্বাসন করার জন্য এখন পর্যন্ত বড়ো কোনো উদ্যোগ নেই।”
“ফেরত আসা এসব কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আবার কাজে যুক্ত করা এবং দেশের মধ্যে কাজের সুযোগ তৈরি করার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে,” যোগ করেন তিনি।
“তা ছাড়া বিদেশ ফেরত পুরুষদের তুলনায় নারীদের সামাজিক সংকট বেশি। সব কিছু মিলিয়ে দেখা যায়, যাওয়ার আগে যতটা ভালনারেবল তাঁরা ছিলেন, দেশে ফিরে আসার পর তা অনেকাংশেই বেড়েছে,” মনে করেন শরিফুল হাসান।
এ বিষয়ে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক শহীদুল ইসলাম (বিএমইটি) বেনারকে বলেন, করোনা মহামারি পুরো পৃথিবী ওলট–পালট করে দিয়েছে। এতে আমাদের জনশক্তি রপ্তানি খাতও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এর মধ্যে ফেরত আসার পাশাপাশি আমাদের অনেক শ্রমিক সৌদি আরব যাচ্ছে, এটা আশার কথা।”
“তবে ফেরত আসাদের সবাই যে চাকরি হারিয়ে আসছেন তেমনটি নয়, অনেকেরই চাকরি মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। অনেকে আবার স্বেচ্ছায় ফিরে আসে,” বলেন তিনি।
শহীদুল ইসলাম বলেন, যারা ফেরত আসছেন তাঁদের জন্য সরকার পুনর্বাসন ব্যবস্থা চালু করেছে। দেশে ফেরত আসা দুই লাখ কর্মীকে ১৩ হাজার পাঁচশ টাকা নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে। পাশাপাশি যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে আরো দক্ষ কর্মী তৈরি করে আবারও তাঁদের বিদেশ পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
“তারা যদি দেশে কিছু করতে চান সে বিষয়ে ব্যাংক ঋণ থেকে শুরু করে সার্বিক সহায়তা দেওয়া হবে। এক কথায় বিদেশ ফেরত কর্মীদের যেকোনো সহায়তায় পাশে রয়েছে সরকার,” বলেন বিএমইটি মহাপরিচালক।