বছরে চার হাজার কর্মী নেবে গ্রিস, বৈধ হবেন কাগজপত্র ছাড়া ১৫ হাজার বাংলাদেশি

জেসমিন পাপড়ি
2022.02.09
ঢাকা
বছরে চার হাজার কর্মী নেবে গ্রিস, বৈধ হবেন কাগজপত্র ছাড়া ১৫ হাজার বাংলাদেশি ঢাকার হযরত শাহ্‌জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। ২১ নভেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশ থেকে বছরে ৪ হাজার কর্মী নেবে ইউরোপের দেশ গ্রিস, যারা মূলত কৃষি কাজ করবেন। এ বিষয়ে বুধবার ঢাকার প্রবাসীকল্যাণ ভবনে বাংলাদেশ ও গ্রিসের মধ্যে সমঝোতা স্মারক হওয়ার কথা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং গ্রিসের পক্ষে গ্রিসের মিনিস্টার অব মাইগ্রেশন অ্যান্ড অ্যাসাইলাম প্যানাইয়োটিস মিতারাচি এতে সই করেন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই সমঝোতা স্মারকের আওতায় প্রতিবছর ৪ হাজার নতুন বাংলাদেশি কর্মীকে সেদেশে কাজ করার সুযোগ দেবে গ্রিস। একইসঙ্গে গ্রিসে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা পর্যায়ক্রমে বৈধভাবে কাজ করার সুযোগ পাবেন।

মন্ত্রণালয় বলছে, শ্রমিকরা পাঁচ বছর মেয়াদি অস্থায়ী কাজের অনুমতি পাবেন। আপাতত শুধু কৃষি খাতে কর্মী নেওয়া হলেও ধাপে ধাপে অন্য খাতে চাহিদার ভিত্তিতে কর্মীর সংখ্যা বাড়াবে দেশটি। পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে বাধ্যতামূলকভাবে কর্মীদের দেশে ফিরে আসতে হবে।

সমঝোতা স্বাক্ষরের পর গ্রিক মন্ত্রী মিতারাচি বলেন, এই চুক্তিটি গ্রিসের পার্লামেন্টে অনুমোদনের মাধ্যমে শিগগির বাস্তবায়ন করা হবে।

“বাংলাদেশি কর্মীরা পরিশ্রমী হলেও মানব পাচারকারীরা তাঁদের ফাঁদে ফেলে সর্বস্বান্ত করছে। এ চুক্তির ফলে বাংলাদেশি কর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে,” বলেন তিনি।

অন্য দেশেও কর্মী পাঠানোর আশা

ইউরোপের কোনো দেশের সঙ্গে এটি বাংলাদেশের কর্মসংস্থানসংক্রান্ত প্রথম সমঝোতা স্মারক উল্লেখ করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের কর্মীরা নিরাপদে গ্রিসে গিয়ে বৈধভাবে কাজ করতে পারবেন।

এ বিষয়ে গ্রিসে নিযুক্ত বাংলাদেশর রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমেদ বেনারকে বলেন, “এই চুক্তি সফল হলে ধীরে ধীরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশও এটা ফলো করার চেষ্টা করবে। সেই হিসেবে বলা যায় এই চুক্তি একটা মাইলফলক, যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বাংলাদেশের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হতে পারে এই চুক্তির মাধ্যমে।”

এমন একটা সময়ে গ্রিসের সাথে এই চুক্তি করা হলো যখন অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের জন্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে বহু বাংলাদেশি প্রতিনিয়ত সমুদ্রে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছেন।

গ্রিসকে অবৈধ পথে ইউরোপে প্রবেশ করার অন্যতম গেটওয়ে বা দুয়ার বলা হয়। বিভিন্ন সময় বহু বাংলাদেশি অবৈধ পথে দেশিটিতে প্রবেশ করেছেন। তাঁদের অনেকে সে দেশে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। আবার অনেকে ইউরোপের অন্য কোনো দেশে যাওয়ার আশায় গ্রিসে প্রবেশ করেছেন।

বর্তমানে গ্রিসে প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমেদ বেনারকে বলেন, “এদের মধ্যে ১২ হাজার কর্মীর বৈধ কাগজপত্র আছে। বাকি আনডকুমেন্টেড কর্মীদের মধ্যে ১৫ হাজার কর্মীকে এই চুক্তির আওতায় বৈধ কাগজপত্র দেওয়া হবে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এই আনডকুমেন্টেড কর্মীদের বৈধ করার পাশাপাশি প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে নতুন চার হাজার কর্মী নেবে গ্রিস। তারা নয় মাস কাজ করার পরে ৩ মাস ছুটি পাবেন। এই সময়ে তাঁরা চাইলে দেশে ফিরে পরিবারের সাথে সময় কাটিয়ে আবার কাজে ফিরতে পারবেন।”

“চুক্তি শেষ করে পাঁচ বছর পর দেশে ফিরলে নতুন করে আবার গ্রিসে যাওয়ার সুযোগও পাবেন এসব কর্মীরা,” বলেন রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমেদ।

তিনি জানান, “পুরো বিষয়টি দেখভালের জন্য দুদেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যৌথ কমিটির গঠন করা হবে। ওই কমিটি বছরে একবার মিটিং করবে। এই মিটিং একবার ঢাকায়, অন্যবার এথেন্সে অনুষ্ঠিত হবে।”

বাংলাদেশ থেকে বছরে ৪ হাজার কর্মী নেবার জন্য ঢাকার প্রবাসীকল্যাণ ভবনে সমঝোতা স্মারক হাতে গ্রিসের মিনিস্টার অব মাইগ্রেশন অ্যান্ড অ্যাসাইলাম, প্যানাইয়োটিস মিতারাচি (বামে) ও বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ। ৯ জানুয়ারি ২০২২। [বেনারনিউজ]
বাংলাদেশ থেকে বছরে ৪ হাজার কর্মী নেবার জন্য ঢাকার প্রবাসীকল্যাণ ভবনে সমঝোতা স্মারক হাতে গ্রিসের মিনিস্টার অব মাইগ্রেশন অ্যান্ড অ্যাসাইলাম, প্যানাইয়োটিস মিতারাচি (বামে) ও বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ। ৯ জানুয়ারি ২০২২। [বেনারনিউজ]

অবৈধভাবে যাওয়ার প্রবণতা কমবে

বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার বিষয়ে এই চুক্তি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ গ্রিসে বৈধভাবে কর্মী পাঠানোর সুযোগ তৈরি হওয়ার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার প্রবণতা কমবে বলে মনে করেন রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমেদ।

“মাল্টা ও আলবেনিয়াতেও একই ধরনের চুক্তির জন্য খসড়া দেওয়া আছে। আশা করি সেখান থেকেও ইতিবাচক সাড়া মিলবে। কারণ, এসব দেশে কর্মীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে,” বলেন তিনি।

ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ফর রাইটস অব বাংলাদেশি ইমিগ্রান্টসের (ওয়ারবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বেনারকে বলেন, “ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর মতো সম্পদশালী না হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে গ্রিসই প্রথম নিয়মিত অভিবাসনের দরজা খুলে দিলো। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় সুযোগ।”

“ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কর্মীর প্রয়োজন প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ। গ্রিসের পরে ধীরে ধীরে ইউরোপের অন্যান্য দেশও এই দরজা খুলতে পারে। এই সংবাদটা তরুণ যুবকদের জানাতে হবে, যারা দালালের খপ্পরে পড়ে ইউরোপে প্রবেশের চ্যালেঞ্জ নেয়,” বলেন সাইফুল ইসলাম।

বাংলাদেশ ও গ্রিসের মধ্যকার সমঝোতা স্মারক পাবলিক করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা চাই জিটুজি পদ্ধতিতে গ্রিসে কর্মী পাঠানোর হোক; ঠিক যেভাবে বোয়েসেলের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মী পাঠানো হয়। এখানে রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি যুক্ত হলেই আবার অনিয়মিত অভিবাসনের আশঙ্কা থাকবে,” বলেন তিনি।

নিয়োগকারীরা খরচ দিয়ে কর্মী নেবেন

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ জানান, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার পর নিয়োগকারীরা নিজেদের খরচে কর্মী নিয়ে যাবেন। এ ক্ষেত্রে আগ্রহী ব্যক্তি যেন কোনোভাবে কোনো দালাল বা প্রতারকের খপ্পরে না পড়েন, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আবেদনের সময় বৈধ ট্রাভেল ডকুমেন্ট, বৈধ ওয়ার্ক কনট্রাক্ট, স্বাস্থ্যবীমার প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে এবং নির্ধারিত এসব ফি ও ব্যয় বহন করতে হবে কর্মীদের।

সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে প্রবাসী কল্যাণ সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন এবং গ্রিসের সেক্রেটারি জেনারেল অব মাইগ্রেশন পলিসি পাত্রোক্লস গিওর্গিওদিস উপস্থিত ছিলেন।

গ্রিস সীমান্তের কাছে ১৯ অভিবাসীর মৃত্যু

প্রচণ্ড শীতে জমে তুরস্ক সীমান্তে অন্তত ১৯ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী মারা গেছেন বলে গত ৩ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদে জানিয়েছে তুর্কির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি। গ্রিস সীমান্তের কাছে এ ঘটনা ঘটে।

এতে বলা হয়, গ্রিসের সীমান্তে কর্মকর্তারা এসব অভিবাসীদের পোশাক খুলে নিয়ে তুর্কি ভূখণ্ডে ঠেলে দিয়েছিলেন। ফলে শীতে জমে তাঁরা মারা গেছেন।

বেঁচে যাওয়া চারজন অভিবাসী জানান, গ্রীসের সীমান্ত রক্ষীরা তাঁদের পোশাক খুলে তুর্কি ভূখণ্ডে ঠেলে দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে রিয়াজ নামে একজন বাংলাদেশি সাংবাদিকদের জানান, তিনি তাঁর বন্ধুদের হারিয়েছেন।

যদিও তুরস্কে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছ থেকে বাংলাদেশি মারা যাওয়ার তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

“তারা (গ্রিক কর্তৃপক্ষ) তিন দিন আমাদের খাবার বা পানি দেয়নি। ঠাণ্ডা আবহাওয়ার উপযোগী পোশাক আমাদের ছিল না। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। এরই মধ্যে তারা আমাদের তুর্কি সীমান্তে ঠেলে দেয়,” তিনি বলেন।

“আমাদের মধ্যে কেউ কেউ দ্রুত তুরস্কে চলে এসেছিলাম। তখন একজন তুর্কি সেনাসদস্য আমাদের জুতা, পোশাক ও খাবার দেন। এ কারণে আমরা বেঁচে গেছি,” যোগ করেন রিয়াজ।

অনিয়মিত অভিবাসীদের সাথে মানবিক আচরণ করা উচিত দাবি করে বেঁচে যাওয়া আরেক ব্যক্তি বলেন, “আমার বন্ধুরা মারা গেছে, কারণ তারা (গ্রিস কর্তৃপক্ষ) তাদের পাতলা কাপড় পরা অবস্থায় বের করে দিয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশ অভিবাসীদের সঙ্গে এমন আচরণ করে না। আমরা এখানে চুরি করতে আসিনি, আমরা এখানে কাজ করতে এসেছি,” আনাদোলুকে বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।