অবশেষে মালয়েশিয়া যাওয়া শুরু করেছেন বাংলাদেশি কর্মীরা
2022.08.08
ঢাকা

চার বছর পর বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলেছে। বাংলাদেশ সময় সোমবার রাতে ৫৩ কর্মী মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে গেছেন।
অর্থনীতিবিদ ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার চলমান সংকটের মধ্যে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়া ইতিবাচক ঘটনা। তাঁদের মতে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে দেশের রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে তা বড়ো ভূমিকা রাখবে।
“২০১৮ সালের পর সোমবার থেকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু হচ্ছে। আগামীতে আরও কর্মী যাবে,” সোমবার বেনারকে বলেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ।
তিনি বলেন, “মালয়েশিয়ায় এখন জনশক্তির চাহিদা প্রচুর। তাদের প্রয়োজন যতদিন না মিটবে, ততদিন পর্যন্ত আমরা কর্মীদের সেখানে পাঠাতে পারব।”
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার যেন কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, সেজন্য সরকার তৎপর রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “তবে আমরা নিজেরা যেন কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করি, সেদিকে নজর দিতে হবে।”
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অভিবাসী কর্মীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা বিরাট ভূমিকা পালন করে। দেশের রপ্তানি আয় এবং আমদানি ব্যয়ের মধ্যে যে বিশাল ফারাক থাকে, সেটি পূরণ হয় মূলত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি না করলে বাংলাদেশ সংকটে পড়তে পারে।
বাংলাদেশের শ্রমবাজার মূলত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
সরকারিভাবে বলা হয়, বিশ্বে ৮০ লাখ বাংলাদেশি রয়েছে। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের শ্রম বাজার খুব বড়ো না হলেও গুরুত্বপূর্ণ।
‘অভিবাসন ব্যয় কম রাখতে হবে’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো শুরু হওয়ার বিষয়টিকে “ইতিবাচক” আখ্যায়িত করে সোমবার বেনারকে বলেন, “মালয়েশিয়া আমাদের শ্রমবাজার প্রসারে বড়ো ভূমিকা রাখতে পারে।”
তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে মালয়েশিয়া থেকেই দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে যা আমাদের মোট রেমিটেন্সের প্রায় শতকরা ১১ ভাগ।”
মালয়েশিয়ায় মূলত ‘লো-স্কিলড কর্মী’” চাওয়া হয়, জানিয়ে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এক্ষেত্রে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে।
তিনি বলেন, “মালয়েশিয়ান কোম্পানিগুলো ভারতীয় নেপালি অথবা অন্য দেশ থেকে শ্রমিক না নিয়ে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিতে চায়। এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারলে আমাদের রেমিটেন্সের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি করা সম্ভব।”
তবে তাঁর মতে, বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক পাঠানোর ব্যাপারে “সিন্ডিকেশন হয়” এবং শ্রমিকদের কাছ থেকে অস্বাভাবিক অভিবাসন খরচ নেয়া হয়। ফলে বাংলাদেশ এর প্রকৃত সুবিধা পায় না।
তিনি বলেন, “মালয়েশিয়া থেকে রেমিটেন্স বৃদ্ধি করতে প্রথমত অভিবাসন ব্যয় কম রাখতে হবে, শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা যাতে সহজে, নিরাপদে ও বৈধ পথে দেশে অর্থ পাঠাতে পারেন, সে ব্যাপারে সরকারকে কাজ করতে হবে।”
নতুন চুক্তির আওতায় এখনও কেউ ভিসা পায়নি
মালয়েশিয়ার অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বড়ো অবদান রয়েছে। তবে দুই দেশের দুর্নীতিবাজেরা শ্রম বাজারটি কব্জা করতে সিন্ডিকেট করে অভিবাসন ব্যয় বৃদ্ধি করে।
বিভিন্ন সময় এই সিন্ডিকেটের কারণে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া বন্ধ করেছে মালয়েশিয়া। ফলে অবৈধপথে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা প্রায়ই দেখা দেয়।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি। বরং, করোনা মহামারির মধ্যে প্রচুর শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরত এসেছেন।
এর ফলে মালয়েশিয়ায় ব্যাপক শ্রম ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে থেকে শ্রমিক নেয়া শুরু করতে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে দুই দেশ।
তবে এই স্মারকের আওতায় শ্রমিক পাঠানো শুরুর আগেই অভিযোগ ওঠে যে, একটি মহল বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া দুই দেশে শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি আবুল বাশার সোমবার বেনারকে বলেন, “সোমবার যেসব কর্মী মালয়েশিয়া যাচ্ছেন, তাঁরা ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে ভিসা পেয়েছেন। গত বছর বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সমঝোতা স্মারকের আওতায় এখনও কেউ ভিসা পায়নি।”
তিনি জানান, শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া দুই দেশেই সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন সংস্থা কাজ শুরু করেছে এবং ইতোমধ্যে কয়েকজনকে আটক করেছে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সর্বোচ্চ সুবিধা পাবে বাংলাদেশ।”
তিনি বলেন, “যদি এই বাজারে দুর্নীতি দূর করা যায়, সিন্ডিকেট ভাঙা যায় তাহলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের ৭০ ভাগ পর্যন্ত কর্মীর চাহিদা বাংলাদেশ থেকে পূরণ করা সম্ভব।”
“যদি আমরা সেখানকার শ্রম বাজারের সুবিধা কাজে লাগাতে পারি, তাহলে আগামী কয়েক বছরে পাঁচ থেকে ছয় লাখ শ্রমিক সেখানে পাঠানো যেতে পারে,” বলেন আবুল বাশার।
বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি রয়েছেন বলে জানান তিনি।
মালয়েশিয়া থেকে কী পরিমাণ রেমিটেন্স আনা সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাবে আবুল বাশার বলেন, একজন শ্রমিক গড়ে এক হাজার পাঁচ’শ রিঙ্গিত মজুরি পেলে নিজের খরচ বাদ দিয়ে তিনি এক হাজার রিঙ্গিত সমপরিমাণ প্রায় ২২ হাজার টাকা দেশে পাঠাতে পারেন।