হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা: করোনা বিধিনিষেধে নীরব পঞ্চবার্ষিকী
2021.07.01
ঢাকা

করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধ শুরুর দিনেই হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পঞ্চম বর্ষপূর্তি পড়ায় হামলায় নিহতদের স্মরণে বৃহস্পতিবার কোনো আয়োজন ছিল না রক্তাক্ত সেই স্মৃতিবিজড়িত স্থানটিতে।
ঠিক পাঁচ বছর আগে ২০১৬ সালের ১ জুলাই দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো জঙ্গি হামলার শিকার হয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনায় আসা গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর রোডের ওই প্রতিষ্ঠানটি পরের বছর গুলশান এভিনিউয়ের আরেকটি ভবনে স্থানান্তর করা হয়।
তবে প্রতি বছর এই দিনে পুরানো চত্বরে স্মরণ করা হতো নিহত দেশি-বিদেশিদের। সেখানকার যে ভবনে হলি আর্টিজান বেকারি এবং এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ছিল, সেটিতে এখন প্রতিষ্ঠান দুটির অন্যতম উদ্যোক্তা সাদাত মেহেদীর পরিবার থাকেন।
উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর স্ত্রী সামিরা আহমেদ ওই জায়গাটির মালিক।
হামলার বার্ষিকীতে এবার সেখানে কোনো আয়োজন না থাকা প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার বেনারকে সাদাত জানান, কূটনীতিকরা সরকারি বিধিনিষেধ অমান্য করতে চাননি বিধায় এবার একদিন আগেই শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে গেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইতালি ও ভারতের রাষ্ট্রদূত বুধবার সেখানে এসেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আজ শুধু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের আসার কথা ছিল। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনিও না আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”
ভোর থেকে জড়ো হওয়া সাংবাদিকরা সকাল সাড়ে নয়টার পর উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়িটিতে প্রবেশের অনুমতি পান। সেখানে ঢুকে দেখা যায়-নিহতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ভবনের গায়ে একটি ব্যানার টানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণের জন্য টেবিল সাজানো রয়েছে।
পাশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কূটনীতিকদের দিয়ে যাওয়া ফুলগুলো।
এ সময় সাদাত জানান, সেদিনের হামলার স্মৃতি আজীবন তাড়া করে বেড়াবে তাঁকে।
“বাংলাদেশের প্রশাসনকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কারণ তারা জঙ্গিবাদটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। নয়তো এটা আরো খারাপের দিকে যেতে পারত,” বেনারকে বলেন সাদাত।
তিনি বলেন, “এত বড়ো হামলার পরও বেকারিটি যে আবার চালু করতে পেরেছি এবং সেটা চলছে, এটাই আমাদের জন্য বিশাল প্রাপ্তি।”
নতুন জায়গায় চালু হওয়া বেকারিটির পরিসর আগের চেয়ে অনেক ছোট হলেও সেখানে প্রায় একশ শ্রমিক কাজ করছে বলে জানান সাদাত।
প্রসঙ্গত, জঙ্গি হামলায় ঘটনাস্থলে এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ জঙ্গি ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২৯ জন দেশি–বিদেশি নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিলেন।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন
হলি আর্টিজান বেকারি হামলার পঞ্চম বার্ষিকীর স্মরণে এবং এই মর্মান্তিক ঘটনায় নিহতদের প্রতি সম্মান জানাতে বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত নাওকি ইতো, ইতালির রাষ্ট্রদূত এনরিকো নুনজিয়াটা ও ভারতের রাষ্ট্রদূত বিক্রম কে দোরাইস্বামীর সাথে যোগ দিয়েছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার।
এমনটা উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের অফিসিয়াল ফেসবুক পাতা থেকে তাঁদের পুষ্পস্তবক অর্পণের কয়েকটি ছবি প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের সহকারী প্রেস প্রধান অভীক রহমান বেনারকে জানান, এগুলো বুধবারের ছবি।
করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধের কারণে বার্ষিকীর একদিন আগেই শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন তাঁরা।
ফেসবুকে মার্কিন দূতাবাস বলেছে, “আমরা স্মরণ করছি অবিন্তা কবীরকে, যিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক এবং এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আরো স্মরণ করছি তাঁর সহপাঠী ফারাজ হোসেনকে, যিনি নিরাপদে চলে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তাঁর বন্ধুদের সাথে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।”
“আমরা আরো স্মরণ করছি বার্কলি’র দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও ঢাকাস্থ আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী তারিশি জৈনকে, যিনি গ্রীষ্মকালীন ইন্টার্নশিপের জন্য ফিরে এসেছিলেন,” দূতাবাসের ফেসবুকে উল্লেখ করা হয়।
ওই হামলায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও আহত ২৫ কর্মকর্তার সাহসিকতার প্রশংসা করে মার্কিন দূতাবাস জানায়, “শোকাবহ এই বার্ষিকীতে আমরা সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি।”
হলি আর্টিজান বেকারির পুরানো চত্বরের অস্থায়ী স্মৃতিফলক ছাড়াও অদূরে অবস্থিতি হামলায় নিহত পুলিশ কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম ও মো. সালাহউদ্দিন খানের ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূতেরা।

‘সক্ষমতা হারিয়েছে জঙ্গিরা’
গুলশান পুরানো থানার সামনে নিহত পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাস্কর্য ‘দীপ্ত শপথ’-এ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম দাবি করেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর জঙ্গি বিরোধী অভিযানের কারণে বড়ো হামলার সক্ষমতা হারিয়েছে বাংলাদেশি জঙ্গিরা।
র্যাব প্রধান বলেন, বাংলাদেশে এখন আর কোনো জঙ্গি সংগঠনের “বড়ো ধরনের কোনো আক্রমণ করার সক্ষমতা আছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে না।”
বড়ো ধরনের হামলার জন্য সংগঠিত হওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের জঙ্গিরা আর কখনোই পাবে না উল্লেখ করে ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, “যেহেতু তাদের হামলার সক্ষমতা নেই, তাই কোনো আশঙ্কা আছে বলেও আমরা মনে করি না।”
তবে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুকের মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো “জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে, প্রতিরোধ বা দমনে নয়।”
জঙ্গিবাদ মোকাবেলার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ‘ডি-রেডিক্যালাইজেশন’-এ মনযোগী হওয়া উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা যদি জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ না করে প্রতিরোধ বা দমন করতে চাই, তবে এটাই সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়া উচিত। অথচ এর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটা দুঃখজনক।”