স্বল্প পরিসরের উদ্বোধনী দিয়ে শুরু হচ্ছে মুজিব শতবর্ষ
2020.03.16
ওয়াশিংটন ডিসি ও ঢাকা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর বছরব্যাপী অনুষ্ঠান বর্ণাঢ্যভাবে শুরুর পরিকল্পনা থাকলেও বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস বিস্তারের কারণে তা স্বল্প পরিসরে শুরু হচ্ছে মঙ্গলবার।
মঙ্গলবার ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবাষির্কী। এই দিন থেকে শুরু করে আগামী বছর ২৬ মার্চ পর্যন্ত দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল সরকারের।
তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকির কারণে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কিছুটা সংকোচন করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান উদযাপন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।
সোমবার ঢাকায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সারা দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান হবে না। তা ছাড়া, বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় শিশু সমাবেশ হচ্ছে না।
মঙ্গলবার বিকেলে গণভবনে জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে স্যুভেনির উন্মোচন, স্মারক ডাকটিকিট ও মুদ্রা অবমুক্ত করা হবে বলে জানান কামাল নাসের চৌধুরী।
তিনি বলেন, রাত আটটায় রেসকোর্স ময়দানে আতশবাজি এবং আলোকসজ্জা বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।
করোনাভাইরাস বিস্তারকে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ হিসেবে উল্লেখ করে কামাল চৌধুরী বলেন, পরিকল্পিত অন্যান্য অনুষ্ঠান সুবিধাজনক সময়ে করা হবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন বলেও জানান তিনি।
এছাড়া ২২ ও ২৩ মার্চ সংসদের বিশেষ অধিবেশন বসছে। ওই অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বঙ্গবন্ধুর ওপর বক্তব্য রাখবেন।
মঙ্গলবার ১৭ মার্চ শুরু হয়ে আগামী বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত এক বছরের বেশি সময়কে ‘মুজিব বর্ষ’ হিসাবে ঘোষণা করেছেন শেখ মুজিবের কন্যা ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই কর্মসূচির মূল আকর্ষণ ছিল, ১৭ মার্চ ঢাকার জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে জমকালো কুচকাওয়াজ, যেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ কয়েকজন সার্ক নেতার অংশ নেওয়ার কথা ছিল।
তবে দেশে করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য বিস্তার ঠেকাতে নির্ধারিত জমকালো কর্মসূচির অনেক কিছুই কাটছাঁট করে সরকার। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নির্ধারিত বাংলাদেশ সফরও বাতিল করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী।
আর্থিক কার্যক্রমের স্বচ্ছতার দাবি টিআইবির
সোমবার এক বিবৃতিতে মুজিব বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে সকল আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি)।
মুজিব বর্ষ উদযাপনে এখন পর্যন্ত সব ধরনের অর্থায়ন ও ব্যয়ের তথ্য জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের ‘ওয়েবসাইট ও জনগণের জন্য সহজে অভিগম্য অন্যান্য মাধ্যমে’ প্রকাশের দাবি জানানো হয় টিআইবির বিবৃতিতে।
এতে বলা হয়, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ব্যয়িত সকল অর্থায়ন, সরকারিভাবে খরচ করা অর্থের ব্যবহার এবং আর্থিক লেনদেনের তথ্যের “সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।”
প্রসঙ্গত, মুজিব বর্ষ পালনের বাজেট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে অর্থ মন্ত্রণালয় এই কর্মসূচির জন ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। পাশাপাশি, এ বছর জানুয়ারি মাসে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ মুজিব বর্ষ পালনের জন্য আরও ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে।
এছাড়া মুজিব জন্মশতবার্ষিকী পালনে অবদান রাখার জন্য গত ৩ মার্চ বেসরকারি খাতকেও আহ্বান জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
বিরোধী দল নেই
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানমালায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে গত সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।
তিনি বলেন, “এভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করার কোনো যুক্তি দেখি না। এটি রাজনৈতিকভাবে নয়, সরকারিভাবে পালন করা হচ্ছে। এখানে কোনো রাজনৈতিক দল নেই।”
মান্না বলেন, “এই অনুষ্ঠানে কত টাকা খরচ হচ্ছে, কীভাবে খরচ করা হচ্ছে তার কোনো স্বচ্ছতা নেই।”
“তার চেয়ে যদি সকল রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠান করে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংশোধনের কথা বলা হতো তাহলে অনুষ্ঠানটি তাৎপর্যপূর্ণ হতো বলে আমি মনে করি,” বলেন মান্না।
শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ
ব্রিটিশ ভারতে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ার একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪০ সালে ছাত্র রাজনীতিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও নিষ্পেষিত বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য শেখ মুজিব তাঁর ৫৫ বছর জীবনের প্রায় ১১ বছরই জেলে কাটিয়েছেন বলে ২০১৭ সালে সংসদে এক বক্তৃতায় জানান আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা ও বঙ্গবন্ধুর সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা তোফায়েল আহমেদ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল কেন্দ্রে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অভিযান শুরু হওয়ার পর ২৬ মার্চ ঢাকায় গ্রেপ্তার হন তিনি।
গ্রেপ্তারের পর শেখ মুজিবকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময় তাঁকে কারাগারে বন্দী রাখে পাকিস্তান সরকার।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, গ্রেপ্তারের আগে এক টেলিগ্রাম বার্তার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন শেখ মুজিবুর রহমান।
এর আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিক নির্দেশনা উপস্থাপন করেন শেখ মুজিব। তাঁর ৭ মার্চের ওই ভাষণটি ২০১৭ সালে ইউনেসকোর ডকুমেন্টারি ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর তিনি ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে বাংলাদেশ।
শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশ সরকারে তাঁকে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক হিসাবে, নয় মাস ধরে চলা মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি প্রাণ হারিয়েছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে পদার্পণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান পাশ করে গণপরিষদ। এতে তাঁকে জাতির পিতা হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু মধ্যম সারির কর্মকর্তার এক সামরিক অভ্যুত্থানে ঢাকার ধানমন্ডির বাড়িতে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যের সাথে নিহত হন শেখ মুজিব।
সেই সময় দেশের বাইরে থাকায় তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান।
শেখ মুজিবের বড়ো মেয়ে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের পর থেকে তিনি বর্তমানে টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বঙ্গবন্ধুর সমালোচনার অপরাধে ১০ বছরের জেল হতে পারে এমন বিধান রেখে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ করেছে শেখ হাসিনা সরকার।
সমালোচকদের মতে, এই আইন পাশের মাধ্যমে শেখ হাসিনা মুক্তবুদ্ধি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছেন।
‘এগুলো স্বাধীনতার চেতনা নয়’, বলেন মাহমুদুর রহমান মান্না।