বঙ্গবন্ধু হত্যার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মাজেদ ঢাকায় গ্রেপ্তার
2020.04.07
ঢাকা

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক অন্যতম আসামি ক্যাপ্টেন (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুল মাজেদকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতিমধ্যে তাঁর ফাঁসি কার্যকরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছে সরকার।
মঙ্গলবার ভোর ৩টার দিকে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিস) ইউনিটের একটি বিশেষ দল রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান।
গ্রেপ্তারের পর আব্দুল মাজেদকে চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠান বলে সন্ধ্যায় নিজ বাসা থেকে অনলাইন ব্রিফিংয়ে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তিনি বলেন, “আব্দুল মাজেদ বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র এবং হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়ার পরে বিচারিক এবং আপিল আদালত তাঁকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করে।”
“এখন ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদের বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই ফাঁসি কার্যকর হবে,” বলেন আইনমন্ত্রী।
আপিলের সুযোগ নেই
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যরিস্টার শফিক আহমেদ বেনারকে বলেন, সাধারণত ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যেকোনো আসামি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন। কিন্তু যেহেতু সাজা ঘোষণার অনেক দিন পার হয়ে গেছে। তাই এখন আর ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ আপীল করার কোনো সুযোগ পাবেন না।”
“তবে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে পারবেন। সেটা না চাইলে, বা আবেদন মঞ্জুর না হলে বিধি মোতাবেক তাঁর সাজা কার্যকর করা হবে,” বলেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী।
দীর্ঘদিন পলাতক থাকা বঙ্গবন্ধুর এই অন্যতম ঘাতক আটক হওয়াকে চলমান ‘মুজিববর্ষের উপহার’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
শেখ মুজিব হত্যার দায়ে ফাঁসির দণ্ড নিয়ে পলাতক আরো পাঁচ আসামিকে এ বছরের মধ্যে দেশে ফেরানোর প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন বছরের মাথায় সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে।
ওই ঘটনায় তাঁর স্ত্রী, তিন পুত্র এবং দুই পুত্রবধূসহ তাঁর পরিবারের ২০ জনের মতো সদস্য নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা সামরিক শাসকেরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করেননি।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলে এই নৃসংশ হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়। মামলার শুনানি শেষে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে ১৯৯৮ সালে বিচারিক আদালত সাবেক ১২ সেনা কর্মকর্তার ফাঁসির রায় দেয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আজিজ পাশা ২০০১ সালে বিদেশে মারা যান। ২০০৯ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জীবিত বাকি ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।
এদের মধ্যে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। এরা হলেন সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন (আর্টিলারি)।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক ছয়জনের মধ্যে মাজেদকে গ্রেপ্তার করা হয় মঙ্গলবার। বাকি পাঁচজন হলেন- মোসলেম উদ্দিন, শরিফুল হক ডালিম, খন্দকার আবদুর রশীদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী এবং এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী।
এদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং এসএইচএমবি নূর চৌধুরীর কানাডায় রয়েছেন উল্লেখ করে তাঁদের ফেরত আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলে বেনারকে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
২৩ বছর ভারতে ছিলেন মাজেদ
আসামি আবদুল মাজেদ এতদিন কোথায় ছিলেন সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দেয়নি পুলিশ। তবে এর আগে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের খবরে তাঁর ভারতে পালিয়ে থাকার কথা বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমরা তাকে বাংলাদেশেই পেয়েছি। হয়ত করোনার ভয়ে চলে এসেছে।”
তবে আবদুল মাজেদ গত ২২-২৩ বছর ধরে ভারতের কলকাতায় অবস্থান করছিলেন বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি। যদিও সেখান থেকে তিনি কীভাবে বাংলাদেশে এসেছেন সেই তথ্য মেলেনি।
মঙ্গলবার দুপুরে আবদুল মাজেদকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে তোলা হয়।
এর আগে কিছুটা সময় আব্দুল মাজেদের সাথে কথা হয় উল্লেখ করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হেমায়েত উদ্দিন খান সাংবাদিকদের বলেন, “২৩ বছর ধরে তিনি কলকাতায় থাকতেন বলে জানান। তবে কোথায় ছিলেন সুনির্দিষ্ট জায়গার নাম উল্লেখ করতে পারেননি।”
তিনি বলেন, “গত ১৫-১৬ মার্চ আবদুল মাজেদ ঢাকায় ফেরেন।”
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপ-কমিশনার জাফর হোসেন সাংবাদিকদের জানান, কোনো আইনজীবীও আবদুল মাজেদের পক্ষে দাঁড়াননি। পরে আদালত থেকে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
জেল হত্যা মামলায়ও জড়িত ছিলেন মাজেদ
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তথ্য অনুযায়ী, ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন।
তাঁর প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, “মাজেদ শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যায় অংশগ্রহণ করেননি, তিনি জেলহত্যায়ও অংশগ্রহণ করেছেন বলে আমাদের জানা রয়েছে।”
“খুনের পরে জিয়াউর রহমানের নির্দেশ মোতাবেক সে বঙ্গভবন ও অন্যান্য জায়গায় কাজ করেছে,” বলেন তিনি।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হলে আত্মগোপনে চলে যাওয়া আবদুল মাজেদকে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি দেওয়া হয়।
তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে উপসচিবের মর্যাদায় বিআইডব্লিউটিসিতে যোগ দেন। পরে তাঁকে সচিব পদেও পদোন্নতি দেওয়া হয়।