বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামি মাজেদের ফাঁসি কার্যকর
2020.04.11
ঢাকা

গ্রেপ্তার হওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় ফাঁসিতে ঝুললেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদ। বাংলাদেশ সময় শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ০১ মিনিটে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
ফাঁসির পর কারাগারের সামনে ব্রিফিং করেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “রাত ১২ টা ১ মিনিটে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম খুনি আব্দুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।”
২০১৬ সালের ১০ এপ্রিল উদ্বোধনের পরে কেরানীগঞ্জের কারাগারে এই প্রথম কোনো আসামির ফাঁসি কার্যকর হলো বলেও উল্লেখ করেন কামাল পাশা।
আব্দুল মাজেদ বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত ষষ্ঠ ব্যক্তি। এর আগে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি এই মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ জনের মধ্যে পাঁচ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। তাঁরা হলেন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ, এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন।
এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় মাজেদের স্ত্রী সালেহা বেগমসহ পাঁচ স্বজন শেষবারের মতো তাঁর সাথে দেখা করেন বলে জানায় কারা অধিদপ্তর সূত্র।
ফাঁসি কার্যকরের পরে আব্দুল মাজেদের মরদেহ তাঁর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাঁরা জানান, আবদুল মাজেদের গ্রামের বাড়ি ভোলায় তাঁকে দাফন করা হবে। যদিও সেখানকার জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর খুনির মরদেহ সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে আসছেন।
সরকারে স্বস্তি
রায় কার্যকরের পরপরই গণমাধ্যমে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “এই ফাঁসি কার্যকর করতে পেরেছি এটা আমাদের জন্য বিরাট স্বস্তির ব্যাপার। আব্দুল মাজেদ বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত খুনি। এমন ব্যক্তিকে সমাজে রাখাটাই উচিত না।”
“এই রায় কার্যকর করার মাধ্যমে জনগণের কাছে আমাদের যে প্রতিশ্রুতি ছিল সেটা রক্ষা করতে পেরেছি,” বলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার দণ্ড নিয়ে বিদেশে যারা এখনো পলাতক রয়েছেন তাঁদেরও দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে বলে জানান আইনমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বাকি ছয়জনের মধ্যে আবদুল আজিজ পাশা ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা যান, বাকি পাঁচজন এখনো পলাতক। তাঁরা হলেন- মোসলেম উদ্দিন, শরিফুল হক ডালিম, খন্দকার আবদুর রশীদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী এবং এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী।
এদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং এসএইচএমবি নূর চৌধুরীর কানাডায় রয়েছেন উল্লেখ করে তাঁদের ফেরত আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলে এর আগে বেনারকে জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ
গ্রেপ্তারের পর গত ৮ এপ্রিল বিশেষ বিবেচনায় আদালত চালু করা হলে আব্দুল মাজেদের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক এম হেলাল উদ্দিন চৌধুরী। সেদিনই মৃত্যু পরোয়ানার ফাইল কারাগারে পৌঁছায়। এরপরপরই কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন মাজেদ।
তবে পরদিনই প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচের সিদ্ধান্ত জানান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চুড়ান্ত রায় জানায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের রায়ের পর দীর্ঘদিন পলাতক থাকায় ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ হারান আবদুল মাজেদ। ফলে তাঁর ফাঁসির দণ্ড থেকে বাঁচার একমাত্র সুযোগ ছিল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া। সেখানেও প্রত্যাখ্যাত হন তিনি। এরপরেই তাঁর ফাঁসি কার্যকরের আয়োজন করে কারা কর্তৃপক্ষ।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন বছরের মাথায় সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে।
ওই ঘটনায় শেখ মুজিবের স্ত্রী, তিন পুত্র এবং দুই পুত্রবধূসহ তাঁর পরিবারের ২০ জনের মতো সদস্য নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলে এই নৃসংশ হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়। মামলার শুনানি শেষে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে ১৯৯৮ সালে বিচারিক আদালত সাবেক ১২ সেনা কর্মকর্তার ফাঁসির রায় দেয়। ২০০৯ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও এই রায় বহাল থাকে।
২৩ বছর ভারতে ছিলেন মাজেদ
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায়ে ফাঁসির দণ্ড নিয়ে পলাতক আব্দুল মাজেদ গত ৭ এপ্রিল ঢাকায় গ্রেপ্তার হন।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট জানায়, গ্রেপ্তারের পরে আসামি আবদুল মাজেদ জানান, ২৩ বছর ধরে তিনি ভারতে পালিয়ে ছিলেন।
ভারতে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকায় গত ২৬ মার্চ ময়মনসিংহ সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন তিনি। সিটিটিসি গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গত ৭ এপ্রিল ভোর তিনটার দিকে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
মাজেদ আটক হওয়ার পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা তাকে বাংলাদেশেই পেয়েছি। হয়ত করোনাভাইরাসের ভয়ে দেশে চলে এসেছে।”