রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাচ্ছে নাজমুল হুদার ‘তৃণমূল বিএনপি’
2023.02.09
ঢাকা

রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে বিএনপি’র সাবেক নেতা ও সমালোচিত সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার দল “তৃণমূল বিএনপি”।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে জানান, উচ্চ আদালতের আদেশে নির্বাচন কমিশন এই নিবন্ধন দিতে যাচ্ছে।
এর আগে একাধিকবার নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলেও বাছাই পর্বে বাদ পড়ে দলটি।
আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসি’র নতুন দল নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলমান। নিবন্ধন পেলে নিজস্ব প্রতীকসহ আগামী নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপি অংশ নিতে পারবে।
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বেঞ্চ “তৃণমূল বিএনপি” নিবন্ধন দিতে ইসিকে আদেশ দেন।
প্রতীক হবে ‘সোনালি আঁশ’
“আপিল বিভাগ থেকে তৃণমূল বিএনপিকে নিবন্ধন দেওয়ার জন্য ইসিকে আদেশ দেওয়া হয়েছে” জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর জানান, “যত দ্রুত সম্ভব তাদের নিবন্ধন দেওয়া হবে।”
একই রকম নামে এই দলকে নিবন্ধন দিলে কোনো জটিলতা তৈরি হতে পারে কি না জানতে চাইলে আলমগীর বলেন, “এখানে ইসি’র কিছু বলার নেই। সর্বোচ্চ আদালত থেকে সিদ্ধান্ত এসেছে। আদালত তাদের প্রতীকও নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাদের প্রতীক হবে ‘সোনালি আঁশ’।”
“যাচাই-বাছাই করে নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষমতা ইসি’র। অন্যদিকে আদালতের আদেশ মানতে ইসি বাধ্য। আদালতের আদেশের পর এখানে যাচাই করার কোনো প্রয়োজন নেই,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পদ্ধতি চালু হয় ২০০৮ সালে। ওই বছরই নিবন্ধন পায় ৩৯টি দল। এ পর্যন্ত নিবন্ধন পেয়েছে মোট ৪৪টি দল।
তবে আদালতের আদেশ ও নির্বাচন কমিশনের শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থ হওয়ায় এর মধ্যে পাঁচটি দলের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। চারটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হয় কে এম নূরুল হুদা কমিশনের আমলে।
নিবন্ধন পাওয়ার পরে স্থায়ী গঠনতন্ত্র জমা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এক বছরের মাথায় ফ্রিডম পার্টির নিবন্ধন বাতিল হয়।
নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম ও বাংলাদেশ কংগ্রেস উচ্চ আদালতে যায় এবং আদালতের আদেশে নিবন্ধন পায়।
আদালতের আদেশে এনডিএমকে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন দেয় ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। বাংলাদেশ কংগ্রেস নিবন্ধন পায় ২০১৯ সালের ৯ মে।
কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার শঙ্কা
তৃণমূল বিএনপি’র নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত “নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করবে” বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন।
কারণ হিসেবে তিনি বেনারকে বলেন, “রাজনৈতিক দল হিসেবে এর কোনো অবস্থান নেই। রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত শর্তগুলো এই দলের নেই।”
তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা আদালতের রায় অনুযায়ী তৃণমূল বিএনপি’র নিবন্ধন দিচ্ছে, কিন্তু আদালত কী কী শর্তে তাদের নিবন্ধন দিতে বলেছে সেই ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কিছু বলছে না। আমার মনে হয় না নির্বাচন কমিশনের শর্ত লঙ্ঘন করে, আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এই দলকে নিবন্ধন দিতে বলেছেন আদালত।”
“রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন যদি আদালত থেকে নির্ধারিত হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনের দরকার কী? ...প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন তাদের প্রকৃত অবস্থান রাখতে পারছে না, এটি দুঃখজনক,” বলেন সাখাওয়াত।
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইন, ২০২০ অনুযায়ী নিবন্ধন পাওয়ার উল্লেখযোগ্য শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- আবেদনকারী দলকে আবেদনের তারিখ থেকে পূর্ববর্তী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে কমপক্ষে একটি আসনে জয় লাভ করতে হবে, অথবা ওই দুই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কোনো একটি আসনে মোট ভোটের কমপক্ষে শতকরা পাঁচ ভাগ ভোট পেতে হবে।
অথবা ওই দলের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি এবং কেন্দ্রীয় দপ্তর থাকতে হবে এবং ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলা, কমপক্ষে ১০০ উপজেলা অথবা মেট্রোপলিটন থানায় কার্যকর দপ্তরসহ ন্যূনতম ২০০ ভোটার-সদস্য থাকতে হবে।
এছাড়াও, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব পর্যায়ের কমিটিতে কমপক্ষে শতকরা ৩৩ ভাগ সদস্য পদ নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য থাকতে হবে।
‘নির্বাচন কমিশন নিজেকে বিতর্কিত করল’
দেশের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দীন স্বপন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “তৃণমূল বিএনপি’র মতো একটি নাম সর্বস্ব দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচন কমিশন নিজেকে আরও বিতর্কিত করল।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ চায় না বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। সেই কারণে আগামী নির্বাচন নিজেদের মতো করে অনুষ্ঠিত করতে, ক্ষমতায় যেতে, বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বন করছে। তৃণমূল বিএনপি’র নিবন্ধন পাওয়া সেই কূটকৌশলের অংশ।”
জহির উদ্দীন স্বপন বলেন, “তারা বিভিন্ন ছোট ছোট নাম সর্বস্ব দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়ে দেখাতে চাইবে বিরাট সংখ্যক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। দুঃখের বিষয়, এই কূটকৌশল বাস্তবায়ন করতে তারা নির্বাচন কমিশন এবং দেশের আদালতকে অপব্যবহার করছে। তবে তাদের সেই কূটকৌশল সফল হবে না।”
তবে বিএনপির এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে বিভিন্ন শর্ত রয়েছে। শর্ত পূরণ করলে সেই দলকে নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন। এর সঙ্গে সরকারের কোনো সংযোগ নেই।”
“বিএনপি সব কিছুর জন্য সরকারকে দায়ী করে থাকে। আমি তাদের বলব, এসব কাজ বন্ধ করে আগামী নির্বাচনের জন্য তাদের প্রস্তুত করাটাই সঠিক সিদ্ধান্ত হবে,” বলেন ফারুক খান।
সমালোচিত নাজমুল হুদা
বিভিন্ন সময় বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য আলোচিত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের তথ্যমন্ত্রী ও ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন।
যোগাযোগমন্ত্রী থাকার সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে সিএনজিচালিত বেবিট্যাক্সির নিবন্ধন ও রুট পারমিট দিতে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ আনেন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যরা। তাঁর বিরুদ্ধে সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
বিএনপি সরকারের পতন হলে ২০০৭ সালের সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
অভিযোগে বলা হয়, খবরের অন্তরালে নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য এক ব্যক্তির কাছ থেকে দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন নাজমুল হুদা ও তাঁর স্ত্রী। ২০০৭ সালের ২৭ আগস্ট বিচারিক আদালত নাজমুল হুদাকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও আড়াই কোটি টাকা অর্থদণ্ড এবং তাঁর স্ত্রী সিগমা হুদাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রসিকিউটর খুরশীদ আলম খান বেনারকে বলেন, “বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন নাজমুল হুদা। হাইকোর্ট ২০১৭ সালে তাঁর সাজা কমিয়ে চার বছর করে।”
তিনি আরও বলেন, “নাজমুল হুদা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ-টু-আপিল (আপিল করার অনুমতি) করে আপিল করার অনুমতি পেয়েছেন।”
“একজন দণ্ডিত ব্যক্তির রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়া বোধ হয় সঠিক সিদ্ধান্ত নয়,” বলেন খুরশীদ আলম।