সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বীর উত্তম খেতাব বাতিল, রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক

পুলক ঘটক
2021.02.10
ঢাকা
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বীর উত্তম খেতাব বাতিল, রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের পোস্টার নিয়ে বিজয় দিবসে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের শোভাযাত্রা। ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮। [এপি]
Photo: Benar

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্তে দেশে নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

খেতাব বাতিল প্রসঙ্গ গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে এর প্রতিবাদে বুধবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে মিছিল–সমাবেশ করেছে দলটির নেতা–কর্মীরা।

মঙ্গলবার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চার আত্মস্বীকৃত খুনিদের রাষ্ট্রীয় খেতাবসহ জিয়াউর রহমানের ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। 

বিষয়টি নিশ্চিত করে জামুকার সদস্য শাহজাহান খান এমপি বেনারকে বলেন, “জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের আইনগত দিকটি খতিয়ে দেখার জন্য সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছে।” 

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান শাজাহান খান ওই কমিটির প্রধান।

“কমিটি আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করবে এবং সব কিছু ক্ষতিয়ে দেখে শিগগির মতামত জমা দেবে,” বলেন শাজাহান খান।

“এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত নিম্নমানের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার দৃষ্টান্ত,” বেনারকে বলেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

“শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরোচিত কর্মের মাধ্যমে বীর উত্তম খেতাব অর্জন করেছেন। এটা কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারো নেই,” বলেন তিনি।

“এখন পর্যন্ত এটা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত। আমি আশা করব সরকার জামুকার এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে না, যদি করে তা হবে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক,” যোগ করেন তিনি। 

তবে শাহজাহান খানের মতে, “সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী। একজন রাষ্ট্রদ্রোহীর খেতাব বাতিলের অধিকার রাষ্ট্রের আছে।” 

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে শাজাহান খান বলেন, “স্বাধীন দেশে জিয়ার কর্মকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে ছিল। তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের হত্যা করেছিলেন। এরকম একজন ব্যক্তির খেতাব বাতিল করা উচিত।”

‘এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ছিলেন জিয়াউর রহমান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার ষড়যন্ত্রে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে আসছে। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় তাঁর নাম অভিযোগপত্রে ছিল না। 

এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর পলাতক চারজন খুনির মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া বীরত্বপূর্ণ খেতাব স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে ওই নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।

সেই প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার জামুকার ৭২তম সভায় বঙ্গবন্ধুর খুনি শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী ও মোসলেহ উদ্দিনের রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সিদ্ধান্তগুলো সুপারিশ আকারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর গেজেট বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

শরিফুল হক ডালিমের নামের সঙ্গে ‘বীর উত্তম’, নূর চৌধুরীর নামের সঙ্গে ‘বীর বিক্রম’, রাশেদ চৌধুরীর নামের সঙ্গে ‘বীর প্রতীক’ ও মোসলেহ উদ্দিনের নামের সঙ্গে ‘বীর প্রতীক’ উপাধি ছিল।

তাঁদের সঙ্গে জিয়ার খেতাবও বাতিলের ব্যাপারে মতামত জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক আফসান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমি মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি রাজনীতিবিদদের বিষয়। তাই আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।” 

‘আর্টিকেল ১৯’ এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল বেনারকে বলেন, “এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা অনাবশ্যক। এর ফলে নতুন রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম হবে।”

“সংসদ ভবন চত্বর থেকে জিয়াউর রহমানের মাজার সরানো, জিয়ার স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিলসহ এ ধরনের বিষয় নিয়ে যেসব বিতর্ক এবং কথাবার্তা, তা বড়ই নিষ্ঠুর,” বলেন তিনি।

এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “সরকার বদলের সঙ্গে সব কিছু বদল হতে পারে না। এখন যে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে পরবর্তীতে সরকার বদল হলে সেই সিদ্ধান্ত থাকবে না। এটা চলতে পারে না। যখন জিয়াকে খেতাব দেওয়া হয়েছিল তখন যে সরকার ছিল, সেই সরকারের সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে হবে।”

জিয়াউর রহমানের বীর উত্তম খেতাব বাতিলের ক্ষেত্রে কোনো আইনি জটিলতা বোধ হয় নেই বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বুধবার দুপুরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনা ভ্যাকসিন নেওয়ার পর সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই জিয়াকে ‘বীর উত্তম’ খেতাব দেয়া হয়। এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এই খেতাব পেয়েছেন মোট ৬৮ জন। 

এই খেতাব যারা পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ছাড়া বাকি সবাই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে খেতাবের তালিকায় স্বাক্ষর করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা জিয়া সেনাপ্রধান হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ক্ষমতা দখল করেন। তার পরের বছর তিনি রাষ্ট্রপতির পদও দখল করেন। তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। 

১৯৮১ সালে এক সেনা অভ্যুত্থানে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর রাজনৈতিক নানা ঘটনাপ্রবাহে বিএনপির নেতৃত্বে আসেন তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।