বাড়ছে খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ: বিদেশ যেতে পারবেন না, বাসায় থাকতে হবে
2021.03.08
ঢাকা

দুর্নীতির দুই মামলায় দণ্ডিত হবার পর মানবিক বিবেচনায় এক বছর ধরে সাময়িক মুক্তি ভোগ করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়াতে সম্মতি দিয়েছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
“যেসব শর্ত আগে ছিল, সেগুলো বহাল রাখা সাপেক্ষে তাঁর সাজা স্থগিতের সময়সীমা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এখন বাকি সিদ্ধান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই নেবে,” এ প্রসঙ্গে সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
সুপারিশ ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় আইন মন্ত্রণালয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের পুরোনো দুটি শর্ত হলো- তিনি ঢাকায় তাঁর নিজ বাসায় থাকবেন এবং দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
তবে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও আইনজীবী সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের মতে, “এই দুটি শর্তের বেড়াজালে ৭৫ বছর বয়সী প্রবীণ নেত্রীর মানবাধিকার সম্পূর্ণভাবে রহিত করে রাখা হয়েছে।”
“যখন রাজনৈতিক শর্তের আড়ালে চিকিৎসার মতো সাংবিধানিক অধিকারকেও বাধাগ্রস্ত করা হয়, তখন সেটা আর মানবিক বিবেচনা থাকে না, রাজনৈতিক চাল হিসেবেই বিবেচ্য হয়,” বেনারকে বলেন তিনি।
খালেদার সাময়িক মুক্তিকে “একটা বন্দি পাখির পায়ের শিকল ছেড়ে দিয়ে খাঁচার দরজা বন্ধ করে রাখার মতো,” বলে আখ্যায়িত করেন আলাল।
এ ব্যাপারে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না জানাতে চাইলে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার ভাই-বোনেরা চাচ্ছেন, তাঁর সুচিকিৎসা নিশ্চিতের বিষয়টি রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকুক। মানবিক দিক বিবেচনা করে বিএনপিও বিষয়টি রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে চাচ্ছে না।
বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার সাজা গত বছরের ২৪ মার্চ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে তাঁকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয় সরকার।
এর পরে গত সেপ্টেম্বরে তাঁর মুক্তির মেয়াদ আরো ছয় মাসের জন্য বাড়ানো হয়, যা চলতি মাসের ২৪ তারিখে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তৃতীয় দফায় খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য গত ২ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন তাঁর ছোট ভাই শামীম ইসকান্দার।
আবেদনে সাজা মওকুফের পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতিও চাওয়া হয় বলে ৩ মার্চ সাংবাদিকদের জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তবে এই মুহূর্তে খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে পারবেন না জানিয়ে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “দেশে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে আপত্তি করবে না সরকার।”
‘রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়’
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা দুর্নীতির মামলায় দুই বছর এক মাস ১৭ দিন সাজাভোগের পর ‘মানবিক কারণে’ মুক্তি পেয়ে গত বছর ২৫ মার্চ গুলশানে ভাড়া বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া।
এর আগে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজা পেয়ে কারাজীবন শুরু করেন তিনি৷
পরে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও তাঁকে সাজা দেয় আদালত। বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে আরো ৩৪টি মামলা চলমান রয়েছে৷
মানবিক কারণের কথা বলেও খালেদা জিয়ার সাময়িক মুক্তি রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী।
“কোনো কিছুই রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়। মানবিক কারণে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার কথা বলাটাও সরকারি দলের ভাবমূর্তি উন্নয়নেরই অংশ,” বেনারকে বলেন তিনি।
তাঁর মতে, “খালেদা জিয়া না হয়ে এক্ষেত্রে কোনো সাধারণ সাজাপ্রাপ্ত হলে তিনি কিন্তু এভাবে শর্ত সাপেক্ষে জেলের বাইরে থাকতে পারতেন না। যেহেতু উনি রাজনীতি করেন, উনার একটি রাজনৈতিক দল আছে, সে জন্যই এই সুযোগটা পেয়েছেন।”
উল্লেখ্য, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৪০১ ধারার এক উপধারা প্রয়োগ করে খালেদা জিয়াকে দফায় দফায় সাময়িক মুক্তি দিয়ে যাচ্ছে সরকার। এই আইন অনুযায়ী সরকার শর্তসাপেক্ষে বা বিনা শর্তে কোনো দণ্ডিত ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত অথবার সম্পূর্ণ বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করতে পারে।
“বাংলাদেশে এর আগে এই ধারায় সাজা স্থগিত করার কোনো নজির ছিল না,” জানিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এর আগে বেনারকে বলেছিলেন, “এই আইনে মুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর এবং দণ্ড মওকুফ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করারও সুযোগ রয়েছে।”
তবে খালেদা জিয়ার “দণ্ডাদেশ মওকুফের আবেদন বিবেচনার সুযোগ নেই,” বলে সোমবার জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী।
এদিকে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বেনারকে জানান, দুর্নীতি অভিযোগে কারো বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা কোনো মামলা সরকার চাইলেই প্রত্যাহার করতে পারবে না বলে গত ডিসেম্বরে হাইকোর্টের একটি রায় রয়েছে।
‘চিকিৎসা শুরু করা যায়নি’
বর্তমানে মানসিকভাবে কিছুটা ভালো থাকলেও খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি বলে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে বেনারকে জানান বিএনপিপন্থী ডাক্তারদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিশেয়ন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশিদ।
তিনি বলেন, “বাসায় স্বজনদের মাঝে মানসিকভাবে কিছুটা ভালো থাকলেও তাঁর শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি, বরং কিছুটা অবনতি হয়েছে। কারণ যথাযথ চিকিৎসা শুরু করা যায়নি।”
“রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের কারণে উনার একটি হাত বাঁকা হয়ে গেছে। ওই হাত দিয়ে এখন আর কিছুই করতে পারেন না। নিজে বিছানা থেকে উঠতে-নামতেও পারেন না। বাসার মধ্যে চলাচলের জন্যও হুইল চেয়ার প্রয়োজন হয়,” জানান ডা. হারুন।
তিনি বলেন, “খুব দ্রুত বিশেষায়িত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হলে ধীরে ধীরে তিনি একদম পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন।”
এছাড়াও খালেদা ডায়াবেটিস, চোখের সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা আশা করি সরকার তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে আরো মানবিক আচরণ করবে।”