মঙ্গল শোভাযাত্রা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের বাধার মুখে বাম ছাত্ররা
2023.04.14
ঢাকা

বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ ও দ্রব্যমূল্য কমানোসহ কয়েকটি দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে অংশ নেয়ায় ক্ষমতাসীনদের বাধার মুখে পড়েছে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের নেতা-কর্মীরা।
শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের সামনে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হওয়ার পরপরই এই ঘটনা ঘটেছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন আয়োজক ও গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের নেতারা।
ছাত্র জোটের নেতাদের অভিযোগ, মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাধার মুখে পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বাধার মুখেও পড়তে হয়েছে তাঁদের।
শুক্রবার সকালের এই ঘটনাগুলোর দুটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
ওই ভিডিও ফুটেজগুলোর একটিতে দেখা যায় বাম ছাত্রনেতা ও কর্মীরা যেসব প্ল্যাকার্ড নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে যাচ্ছেন সেগুলোতে লেখা রয়েছে— ‘ডিএসএ বাতিল করো’, ‘নববর্ষে পরাধীনতার শিকল ভাঙো’, ‘চাল জোটে না ইলিশ রুই কই পাব?’ ‘মুখ বন্ধ করে দেওয়া কি স্বাধীনতা?’ ‘দাম কমাও, জান বাঁচাও’, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ কর’।
ছাত্র জোটের অন্যতম সংগঠক ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি মুক্তা বারৈ বেনারকে বলেন, “আমরা যখন আমাদের নেতা-কর্মীদের নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় সেইসব স্লোগান নিয়ে হাজির হয়েছি, যা এই মুহূর্তে সত্যিই মঙ্গলের দাবি; তখনই আমরা বাধার মুখে পড়লাম।”
নারী কর্মীসহ অনেকেই লাঞ্ছিত হয়েছেন অভিযোগ করে তিনি বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপন আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক ওম প্রকাশের নেতৃত্বে এই ঘটনা ঘটিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
মুক্তা বারৈ বলেন, “নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্লোগান যখন মঙ্গল শোভাযাত্রা নিতে পারে না, তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না আমরা কতটা নিপীড়নমূলক অবস্থার মধ্যে আছি।”
এ প্রসঙ্গে ওম প্রকাশ বেনারকে বলেন, “গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের নেতা-কর্মীরা রাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নিতে চেষ্টা করায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাঁদের বাধা দিয়েছে। তবে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ সত্য নয়।”
কোন শ্লোগানটিকে রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে জানতে চাইলে প্রকাশ বলেন, “দেখেন ওই প্ল্যাকার্ডগুলোর একটিতে লেখা ছিলা- ‘স্বৈরতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িক পিশাচ রুখে দাও’, এখানে স্বৈরতন্ত্র বলে আসলে তারা কী বুঝাতে চেয়েছে। এটা তো মেনে নেয়া যায় না।”
মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাধা পাওয়া ‘উদ্বেগজনক বিষয়’
এদিকে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সহসমন্বয়ক নজীর আমিন চৌধুরী জয় স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বেলা ১১টায় রাজু ভাস্কর্যের সামনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচিতেও বাধা প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল টিম।
এতে বলা হয়, মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির জাতীয় জীবনে প্রতিবাদের সংস্কৃতি হিসাবে এসেছিল। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে এদেশের ছাত্র জনতা বর্ষবরণকে স্বৈরাচার মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করেছিল।
“কিন্তু আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে নববর্ষ, শোভাযাত্রাকে তার মূল চেতনা থেকে সরিয়ে স্রেফ আয়োজন সর্বস্ব করে তোলার ষড়যন্ত্র চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ মঙ্গল শোভাযাত্রায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বাধা প্রদানের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনায় প্রতীয়মান হয়, সকল ভিন্নমত দমনের ভয়াবহ ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ এই সার্বজনীন উৎসবের মধ্যেও ঘটছে,’ বলা হয় বিবৃতিতে।
“সরকার দলীয় নেতাকর্মী ও শোভাযাত্রার আয়োজকদের মধ্যে আওয়ামী সমর্থকরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধিতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সমালোচনা, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের দাবি পর্যন্ত সহ্য করতে পারছে না। এটা স্পষ্টতই মঙ্গল শোভাযাত্রার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক,” বলা হয় বিবৃতিতে।
গণস্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাকসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমরা কোনো বাধা দেইনি। তাদেরকে বলেছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়ে অনুষ্ঠান করলে ভালো হতো।”
তিনি বলেন, কোনো আইন না হলেও সাধারণত ছাত্র সংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করলে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে করে। “এটা ভদ্রতা,” যোগ করেন মাকসুদুর রহমান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তা বারৈ বলেন, “ছাত্র সংগঠনগুলো গণতান্ত্রিক দাবি নিয়ে বিশ্ব বিদ্যালয়ে কোনো কর্মসূচি পালন করতে হলে প্রশাসনকে জানিয়ে করতে হবে, এই দাবি হাস্যকর এবং এই ধরনের বক্তব্য স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবকেই প্রতিধ্বনিত করে।”
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ও সমাজ-বিশ্লেষক আবুল কাসেম ফজলুল হক বেনারকে বলেন, “স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে গিয়ে বাধার মধ্যে পড়াটা খুবই উদ্বেগজনক বিষয়।”
এই ধরনের ঘটনা থেকে ধারণা পাওয়া যায় ভবিষ্যতে খারাপ সময় অপেক্ষা করছে দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আহমদ শরীফ চেয়ার অধ্যাপক ফজলুল হক বলেন, ইতিবাচক, গণমুখী ও সাংস্কৃতিক বোধ সম্পন্ন রাজনৈতিক জাগরণ ছাড়া এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না।