হিরো আলমকে নিয়ে যৌথ বিবৃতি: নজিরবিহীন ‘আমন্ত্রণ’ আমেরিকাসহ ১৩ কূটনীতিককে
2023.07.26
ঢাকা

ঢাকা-১৭ আসনে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলমের ওপর আক্রমণের পরোক্ষ নিন্দা করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দেওয়ার কারণে আমেরিকাসহ ১৩ পশ্চিমা দেশীয় কূটনীতিকদের অসন্তুষ্ট হয়েছে সরকার।
গত ১৯ জুলাই দেওয়া বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা ১৩ দেশের আবাসিক রাষ্ট্রদূতদের বুধবার দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ‘আমন্ত্রণ’ জানিয়ে এ বিষয়ে সরকারের অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।
ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শাহরিয়ার আলম বলেন, ওই বিবৃতি দেওয়ার মাধ্যমে তাঁরা ১৯৬১ সালের কূটনৈতিক সম্পর্কের নীতি ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছেন এবং ভবিষ্যতে তাঁদের এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এর আগে কখনো দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে মন্তব্য করায় এত সংখ্যক রাষ্ট্রদূতদের একসঙ্গে ডেকে প্রতিবাদ জানানো হয়নি। এটি নজিরবিহীন ঘটনা।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করার দায়ে অভিযুক্ত বাংলাদেশিদের জন্য মার্কিন ভিসা বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার দুই মাস পর এই ঘটনা ঘটল।
কূটনীতিকদের এভাবে ডেকে পাঠানোকে সমর্থন না করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলছে, ঢাকা-১৭ আসনে হিরো আলমের ওপর আক্রমণের ব্যাপারে বিবৃতি দিয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করেছে।
অসন্তুষ্ট বাংলাদেশ
কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জন্য প্রথমে একটি লিখিত বিবৃতি পড়ে শোনান শাহরিয়ার আলম এবং পরে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
লিখিত বিবৃতিতে বলা হয়, গত ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলমকে কেন্দ্র করে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যেসব কূটনৈতিক গণমাধ্যমে যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন, বুধবার দুপুরে তাদের ডেকে “কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণে” “অসন্তোষ” প্রকাশ করা হয়েছে।
কূটনীতিকবৃন্দের বিবৃতি দেওয়ার আগেই হিরো আলমের ওপর আক্রমণের ঘটনায় দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও এই কূটনীতিকরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন, যা অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয়।”
শাহরিয়ার আলম বলেন, “যে দ্রুততা ও গুরুত্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ঘটনাটির সমালোচনা তাঁরা করেছেন, সেই গুরুত্ব ও দ্রুততার সঙ্গে কিন্তু সরকারের গৃহীত তাৎক্ষণিক ও ত্বরিত আইনানুগ ব্যবস্থাকে তাঁরা মূল্যায়ন করেননি। তাই, যৌথ বিবৃতিটির বস্তুনিষ্ঠতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকেই যায়।”
রাষ্ট্রদূতদের কূটনৈতিক আচরণবিধি সম্পর্কিত ভিয়েনা কনভেনশন স্মরণ করিয়ে “গঠনমূলক হওয়ার পরামর্শ” দেয়া হয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “পাশাপাশি এ-ও সতর্ক করা হয়েছে যে, সরকারকে পাশ কাটিয়ে বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাত বর্জিত আচরণ কেবলই পারস্পরিক আস্থার সংকট তৈরি করবে।”
সরকারের বক্তব্যের বিপরীতে কূটনীতিকরা কী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার আলম বলেন, “তাঁরা বলেছেন যে, ওই যৌথ বিবৃতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য দেওয়া হয়েছে। তবে আমরা তাঁদের সেই ব্যাখ্যা গ্রহণ করিনি। বলেছি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে এভাবে মিডিয়াতে যৌথ বিবৃতি দেওয়া ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন।”
“কূটনীতিকদের যৌথ বিবৃতি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সামিল,” ভিয়েনা কনভেনশনকে উদ্ধৃত করে বলেন শাহরিয়ার আলম।
এ ব্যাপারে কূটনীতিকদের মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বেনারকে বলেন, “আগেও অনেকবার বলেছি, অবাধ-সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বাংলাদেশ যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আমরা সেটি সমর্থন করি।”
“সে কারণে আমরা অন্যান্য দূতাবাসের সঙ্গে একত্রিত হয়ে হিরো আলমের ওপর আক্রমণকে নিন্দা জানিয়েছি, ঘটনার পূর্ণ তদন্ত দাবি এবং অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছি,” বলেন তিনি।
ব্রায়ান শিলার বলেন, “এ ব্যাপারে কয়েক জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই।”
প্রসঙ্গত, গত ১৭ জুলাই গুলশান, বনানী ও বারিধারা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলা করে কয়েকজন দুর্বৃত্ত।
ঘটনার পর দুজনকে আটক করে পুলিশ। ওই ঘটনার দু’দিন পর ১৯ জুলাই হিরো আলমের পক্ষে বিবৃতি দেয় ঢাকাস্থ কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
বিএনপি যা বলছে
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুধবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনর্প্রবর্তনের পক্ষে কথা বলার কারণে রাগান্বিত হয়ে সরকার কূটনীতিকদের একসঙ্গে ডেকে পাঠিয়েছে।”
“আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের অধীনে দেশে পরপর দু’টি জালিয়াতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারা আগামী নির্বাচনেও একইভাবে জালিয়াতি করতে চায়,” বলেন তিনি।
হিরো আলমের ওপর আক্রমণের নিন্দা জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়ে পশ্চিমা সরকারগুলো তাদের “গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করেছে” মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, “আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করতেই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার। সে কারণে আওয়ামী লীগ সরকার পশ্চিমা সরকারের প্রতি মনঃক্ষুণ্ণ।”
গত ১৫ বছর অনেকে ‘ভোট দেবারাই সুযোগ পায়নি’
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারে দেয়া এক ভার্চুয়াল বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম বলেছেন বাংলাদেশের নির্বাচনে সরকারি ও বিরোধীদলের জন্য সমান ক্ষেত্র নেই।
সরকারের সমালোচনা করে বিদেশি গণমাধ্যমে সাক্ষাতকার দেয়ার পর ২০১৮ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ১০০ দিনেরও বেশি কারাবাস করা শহিদুল আলম বলেন, সরকার নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার করতে রাজি নয় কারণ তারা জানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তাদের ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা কম।
“এই কারণেই তারা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় না। কারণ তারা আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চায়,” বলেন তিনি।
বর্তমানে বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসার জন্য “জনগণের ভোট প্রয়োজনীয় নয়” মন্তব্য করে শহিদুল আলম বলেন, “সরকারি দল সারা দেশে সব ক্ষেত্রেই নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে,” এবং বহু ভোটার “গত ১৫ বছরে ভোট দেবারাই সুযোগ পায়নি।”
এদিকে এর আগে কখনো বাংলাদেশে এত কূটনীতিককে একসঙ্গে ডেকে প্রতিবাদ জানানো হয়নি বলে বুধবার বেনারকে জানান সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমশের মবিন চৌধুরী। তবে তাঁর মতে, সরকার চাইলে তা করতে পারে।
হিরো আলমের ঘটনায় সরকার যখন ব্যবস্থা নিচ্ছিল তখন কূটনীতিকদের “এভাবে যৌথ বিবৃতি দেওয়া ঠিক হয়নি,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এ ক্ষেত্রে সরকার তার অবস্থানে ঠিক আছে।”
তাঁর মতে, কূটনীতিকদের এইভাবে ডেকে সতর্ক করায় “দেশের মানুষের কাছে মনে হতে পারে যে, বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। তবে আমি তা মনে করি না। কারণ এখনো প্রধানমন্ত্রী ইতালি সফরে রয়েছেন। তিনি এর আগে সুইজারল্যান্ড সফরে গেছেন।”