মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ হারালেন মুরাদ হাসান, গ্রেপ্তার দাবি

আহম্মদ ফয়েজ
2021.12.07
ঢাকা
মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ হারালেন মুরাদ হাসান, গ্রেপ্তার দাবি ড. মুরাদ হাসানের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের বিক্ষোভ। ৭ ডিসেম্বর ২০২১।
[ফোকাস বাংলা]

নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক মন্তব্য ও অশালীন কথোপকথনের একাধিক অডিও ও ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তুমুল সমালোচনার মুখে প্রধানমন্ত্রীর বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে পদত্যাগ করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ড. মুরাদ হাসান।

মঙ্গলবার ই-মেইলের মাধ্যমে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে প্রতিমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ি) আসন থেকে নির্বাচিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্য।

প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গ্রহণ করেছেন বলে মঙ্গলবার রাতে এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। “এ পদত্যাগ অবিলম্বে কার্যকর হবে,” বলেও জানানো হয় প্রজ্ঞাপনে।

এর আগে প্রতিমন্ত্রীর “এই ঘটনাগুলো আসলে দুঃখজনক,” বলে গণমাধ্যমকে জানান তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ।

তিনি বলেন, “মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তিনি আমাদের কোনো কাজে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াননি বরং ডা. মুরাদ হাসান আমাকে সবসময় সহযোগিতা করেছেন। সেজন্য তাঁকে আমি ধন্যবাদ জানাই।”

“তাঁর কিছু বক্তব্য ও ঘটনা সরকার এবং দলকে বিব্রত করেছে। সেকারণে প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগ করার জন্য বলেছেন,” জানান তথ্যমন্ত্রী, যদিও মুরাদ হাসানের কোন কোন বক্তব্য সরকার ও দলকে বিব্রত করেছে সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেননি তিনি।

এর আগে সোমবার রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, অশালীন, শিষ্টাচারবহির্ভূত ও নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর বক্তব্য দেওয়ায় মুরাদ হাসানকে মঙ্গলবারের মধ্যে পদত্যাগ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত ১ ডিসেম্বর মুরাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বিরোধী দল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাতনি ও তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানের উদ্দেশ্যে কিছু অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিও সাক্ষাৎকারে মুরাদ নিজের খারাপ ভাষার জন্য গর্ব বোধও করেন।

মুরাদের ওই বক্তব্যের সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছিলেন নারী অধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে এই প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়। মুরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চায় নারীপক্ষ, আইন ও শালিস কেন্দ্রসহ কয়েকটি অধিকার সংগঠন।

এই সমালোচনা উস্কে দেয় বাংলাদেশের একজন চিত্রনায়িকার সাথে প্রতিমন্ত্রী মুরাদের কথোপকথনের রেকর্ড ফাঁস হওয়ার ঘটনায়। ফোনালাপে থাকা চিত্রনায়ক ও চিত্রনায়িকা ইতোমধ্যে স্বীকার করেছেন যে, ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন প্রতিমন্ত্রী মুরাদ।

দলের পদও হারালেন মুরাদ

মন্ত্রিত্ব হারানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগ থেকেও পদ হারালেন মুরাদ। সোমবার বিকেলে এক জরুরি সভা ডেকে জেলা কমিটির স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদকের পদ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগ।

“দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট, অগঠনতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মুরাদ হাসানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে,” বেনারকে বলেন জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. মুহাম্মদ বাকী বিল্লাহ।

তিনি বলেন, “মুরাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের কাছে সুপারিশ পাঠাবে জেলা কমিটি।”

সংসদ সদস্য পদ থাকা না থাকা নিয়ে প্রশ্ন

সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মুরাদ হাসানের সংসদ সদস্যপদ বাতিল হবে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “সংসদ সদস্য জনগণের নির্বাচিত। তাই চাইলেই বাদ দেওয়া যায় না।”

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো নির্বাচনে কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হবার পর যদি তিনি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে নিজের দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন তবে তাঁর পদ শূন্য হয়।

তবে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কারো সদস্যপদ শূন্য হবে কি না সে বিষয়ে বিতর্ক দেখা দিলে শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য তা নির্বাচন কমিশনে পাঠাতে হবে।

“মুরাদ হাসানের সংসদ সদস্য পথ থাকবে বা চলে যাবে তা নিয়ে মূল আলোচনাটা শুরু হবে তখনি, যখন তিনি দলেরও সাধারণ সদস্যপদ হারাবেন,” বেনারকে বলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ।

“দল যদি মুরাদ হাসানের প্রাথমিক সদস্য পদ বাতিল করে তবে তাঁর সংসদ সদস্য পদও বাতিল হবে,” বেনারকে জানান সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট হারুন-অর-রশীদ।

তাঁর মতে, যেহেতু দল থেকে “পদত্যাগ করা বা বহিষ্কার করার ফলাফল একই, সেহেতু যে কোনো প্রক্রিয়ায় তিনি দলের প্রাথমিক সদস্য পদ হারালে সংসদ সদস্য পদও হারাবেন।”

গ্রেপ্তার দাবি বিএনপির

মুরাদ হাসানকে গ্রেপ্তার ও তাঁর বিচার দাবি করেছে বিএনপি। মঙ্গলবার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই দাবি জানান।

রিজভী বলেন, তিনি (মুরাদ) যে কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা বলেছেন, সে জন্য তাঁকে রাজনীতি করার অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। তাঁকে সকল পর্যায় থেকেই সরিয়ে দিতে হবে এবং প্রচলিত আইনে তাঁর বিচার করতে হবে।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের চরিত্র হননের অপচেষ্টার অভিযোগে মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে একটি মামলার আবেদন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল (এসএম হল) ছাত্র সংসদের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস) জুলিয়াস সিজার তালুকদার।

“মুরাদ হাসান একটি ভিডিওতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া ও শামসুন নাহার হলের নারী শিক্ষার্থীদের চরিত্র হননের অপচেষ্টা,” করার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে ‘আইনি ব্যবস্থা চেয়ে’ অভিযোগ দায়ের করেছেন বলে বেনারকে জানান জুলিয়াস।

অশ্লীল অডিও-ভিডিও সরানোর নির্দেশ

মুরাদ হাসানের ‘অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ’ বক্তব্যের অডিও-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সরানোর নির্দেশ দিয়েছ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক প্রসঙ্গটি আদালতে তুলে ধরে সেগুলো সরানোর নির্দেশনা চাওয়ার প্রেক্ষিতে এই আদেশ দেয় আদালত।

মৌখিক আদেশে আদালত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসির) চেয়ারম্যানের সাথে রাষ্ট্রপক্ষকে আলোচনা করে আদালতকে এ বিষয়ে অগ্রগতি বুধবার জানাতে বলা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।