বিশ্লেষণ: মাঠের সফল কর্মসূচি আশাবাদী করে তুলেছে বিএনপিকে
2022.12.13
ঢাকা

বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের দমন-পীড়নসহ নানা কারণে তৈরি ক্ষোভের প্রেক্ষিতে গত চার বছর ধরে কোণঠাসা বিএনপির নেতাকর্মীরা ক্ষমতার পালাবদলে আশাবাদী হয়ে রাজপথে নেমেছেন, যা রাজনীতিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
যদিও সরকারি দল মনে করছে, বিএনপির এই আন্দোলন তারা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “ক্ষমতাসীন দল এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বাত্মক প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে বিএনপি মাঠের কর্মসূচি পালন করতে সক্ষম হয়েছে। এখন ক্ষমতাসীনরা যেমনই দাবি করুক না কেন, এ যাত্রায় বেশি ক্ষতি আওয়ামী লীগেরই হয়েছে।”
তাঁর মতে, বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে দেওয়া পরিবহন ধর্মঘটসহ নানা প্রতিবন্ধকতার পরও যে বিপুল সংখ্যক লোকসমাগম করতে দলটি সক্ষম হয়েছে, তা মোকাবেলায় আওয়ামী লীগকে রীতিমতো রাজনৈতিক বিরোধী দল, গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে।
“এতে করে যা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলটির নিয়ন্ত্রণমূলক ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ আরও উন্মোচিত হয়ে পড়েছে,” যোগ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগবিরোধী ঐক্যের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “এটা খুব স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে তার গতিপথ পরিবর্তন করতে আগ্রহী না। বিরোধী দলগুলোকে কোনো বাধা ছাড়া তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে এবং মানবাধিকারকে সম্মান করার বিষয়ে বিরুদ্ধ অবস্থান স্পষ্ট।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক তোফায়েল আহমেদের মতে, মানুষ যখন দেখেছে যে, বিএনপি সব বাধা উপেক্ষা করে কর্মসূচি সফল করে তুলছে তখনই বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে ক্রমান্বয়ে উপস্থিতি বাড়তে শুরু করেছে।
“এই বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে সমাবেশগুলো শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করতে পারা বিএনপির জন্য একটি সাফল্য,” বেনারকে বলেন তোফায়েল আহমেদ।
বিএনপির সাম্প্রতিক সমাবেশগুলোর প্রতিটিতে “লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে,” জানিয়ে এ প্রসঙ্গে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বেনারকে বলেন, “অমাদের কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষও অংশ নিতে শুরু করেছে।”
“দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখন খুবই সংগঠিত,” বলেন তিনি।

ভবিষ্যতে সংঘাতের আশঙ্কা
নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে দেশের প্রধান দুই দলের মুখোমুখি অবস্থান বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক সংকট বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিরোধী দলগুলোর চলমান আন্দোলন কর্মসূচিতে সহিংসতা আগামীতে সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে তাঁদের।
“বাংলাদেশে যে সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, ১০ তারিখের সমাবেশে বিএনপিকে চাপে ফেলার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ সংঘাত এড়ানো সম্ভব হবে,” বেনারকে বলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ।
তিনি মনে করেন, সামনের দিনগুলোতে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক ময়দানে শক্তি প্রদর্শনে আরও সক্রিয় হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির ঢাকার সমাবেশে দেওয়া ১০ দফা নতুন দাবি না হলেও একত্রিত করে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের একটি পরিষ্কার রূপরেখা হাজির হলো। এর ভিত্তিতে সমমনা বা আওয়ামীবিরোধী অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও রাজপথে ‘গণতন্ত্র উদ্ধারের’ আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার উপলক্ষ পাবে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বেনারকে বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার পথ উন্মুক্ত রাখা এবং গণতন্ত্র সুরক্ষায় প্রত্যেকেরই এগিয়ে আসা। এ ধরনের মুখোমুখি অবস্থান কোনো ভালো ফল দেবে না।”
“সংসদ থেকে বিএনপি এমপিদের পদত্যাগ একটি বার্তা, তবে বড়ো সমস্যা নয়,” যোগ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ৭ জন সংসদ সদস্য রোববার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। গত ১০ ডিসেম্বর দলটির পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সর্বশেষ ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে তাঁদের পদত্যাগের ঘোষণা আসে।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল, ক্ষমতাসীন দলের পদত্যাগ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনসহ ১০ দফা দাবিও জানানো হয় ওই সমাবেশ থেকে। বিএনপি নেতাদের ভাষ্য, এর মধ্য দিয়ে তাঁদের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছেছে।
“আমরা মনে করি, এই অনির্বাচিত সংসদ জনগণের প্রত্যাশা পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ এবং একটি স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থাকে গণতন্ত্র বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা; তাই আমরা নিজেদের ইচ্ছায় এবং দলীয় সিদ্ধান্তে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছি,” বেনারকে বলেন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা।
অপরদিকে সংসদ থেকে বিএনপি দলীয় সদস্যদের এই পদত্যাগ কোনো প্রভাব তৈরি করবে না বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হারুন।
তিনি বলেন, “এই পদত্যাগে কিছুই যাবে বা আসবে না। এটা বিএনপির অদূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।”
“সংসদ থেকে পদত্যাগ একটি রাজনৈতিক বার্তা হতে পারে কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়,” বলেন আলী ইমাম মজুমদার।
নির্বাচনেই ফাইনাল খেলা হবে: ওবায়দুল কাদের
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুরনো দাবি তুলে বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত না হলে বিএনপি তাতে অংশগ্রহণ করবে না।
কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, ইতোমধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। দাবি আদায়ে আগামী ২৪ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হবে।
আওয়ামী লীগের দাবি, দেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে বাধাগ্রস্ত করতে বিএনপির ৭ সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেছেন।
বিএনপির ৭ সংসদ সদস্য পদত্যাগ করলে সরকার পতন হয় না জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “৩৫০ জন সদস্য নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছে। জাতীয় পার্টি, বিকল্প ধারা আছে।”
সোমবার চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেছেন, “১০ ডিসেম্বরের খেলায় আমরা জিতে গেছি।”
তিনি আরও বলেন, “নির্বাচনেই ফাইনাল খেলা হবে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল আবারও সরকার গঠন করবে।”
বিএনপির উদ্দেশে কাদের বলেন, “বিএনপি এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন বাতিল করা হয়েছে। পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই।”
এ প্রসঙ্গে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বেনারকে বলেন, “বিএনপির গণসমাবেশে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ সরকারকে আতঙ্কিত করে তুলেছে, তাই সরকার দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছে।”
দমন-পীড়নের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে না দাবি করে তিনি বলেন, “এতদিন কর্মসূচি ছিল শুধু বিএনপির। তাতেই লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। এবার শুরু হবে সব গণতন্ত্রকামী দল ও মানুষ নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন।”
রাস্তায় নামার ঘোষণা অন্যদেরও
বিএনপির ঢাকা গণসমাবেশে যুগপৎ আন্দোলনের যে আহ্বান এসেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে বিএনপি জোটের শরিক ও জোটবহির্ভূত বিভিন্ন দল রাজপথে আন্দোলনের কর্মসূচি দিতে শুরু করেছে।
শনিবার ঢাকার সমাবেশের পরপরই জামায়াতসহ কমপক্ষে ১১টি রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাতটি রাজনৈতিক দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চ যুগপৎ আন্দোলন, সরকার ও শাসন ব্যবস্থা বদলে ১৪ দফা ঘোষণা করেছে।
জোট ঘোষিত ১৪ দফার মধ্যে প্রধান দাবি সরকারের পদত্যাগ। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজনৈতিক কারাবন্দির নিঃশর্ত মুক্তি চেয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ।
রাজনৈতিক আদর্শে বিপরীতমুখী অবস্থান থাকায় বিএনপির এই যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থান থাকলেও ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও রাষ্ট্র মেরামতে’ সামনের দিনগুলোতে রাজপথে আন্দোলন বেগবান করার ঘোষণা দিয়েছে ছয়টি বামপন্থী দলের রাজনৈতিক জোট ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’।
জোটের সমন্বয়ক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বেনারকে বলেন, “আমরা মনে করি না বিএনপির আহ্বান আমদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্র উদ্ধারে আমরা আমাদের কর্মসূচি সামনের দিনগুলোতে বেগবান করব।”
এদিকে বিএনপি সামনের দিনের কর্মসূচিগুলো অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করবে বলে জানান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
এ উদ্দেশ্যে একটি লিয়াজো কমিটি গঠনের কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে আমাদের কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে একটি গণআন্দোলন তৈরি করে এই সরকারের পতন নিশ্চিত করা।”

বিদেশি মিশনগুলোতে সরকারের ব্যাখ্যা
ঢাকার কূটনৈতিক মিশনগুলোতে একটি চিঠি দিয়ে গত সাত ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয় এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা দিয়েছে সরকার।
সোমবার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয় ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কোনো পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছিল না, সমাবেশের জন্য বিএনপি পুলিশের অনুমতিও নেয়নি।
এর পরও নিজেদের কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতাকর্মীরা সড়ক অবরোধ করেন। এ অবস্থায় এলাকায় যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় পুলিশ তাদের সরে যাওয়ার অনুরোধ করে।
কিন্তু বিএনপি সমর্থকরা অনুরোধ অগ্রাহ্য করে পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপের পাশাপাশি যানবাহন ভাঙচুর শুরু করেন, এতে ৪৯ জন পুলিশ সদস্যও আহত হন। এবং একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ শুরু হলে একজন পথচারী নিহত হন।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে ওই দিনের সহিংসতার পরিকল্পনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার জন্য কর্মীদের উসকানিতে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানানো হয় ওই চিঠিতে।
প্রসঙ্গত, সোমবার মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসসহ ২২৪ জনের জামিন আবেদন নাকচ করে দিয়েছে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত।
এদিকে দীর্ঘদিন থেকে বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় মঙ্গলবার গ্রেপ্তারের পর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে ঢাকার একটি আদালত।
তবে জামাতের দাবি, গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারের বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের আটকের অংশ হিসেবেই শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।