রাজনৈতিক সংঘাত বৃদ্ধির শঙ্কায় উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা
2023.07.25
ঢাকা

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর অবস্থান ক্রমেই সংঘাতময় হয়ে উঠায় উদ্বেগ বাড়ছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
তাঁদের মতে, করোনা মহামারি পরবর্তী ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সংকটের মধ্যে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকলে তা আমদানি-রপ্তানিসহ দেশের সার্বিক ব্যবসার জন্য বড়ো ধরনের আশঙ্কা তৈরি করবে।
“নির্বাচনের বছরে অর্থনীতি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সবার দুশ্চিন্তা আছে কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা বেশি, কেননা আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ,” বেনারকে বলেন দেশের অন্যতম বড়ো পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ডিবিএল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এম এ রহিম ফিরোজ।
“বিদেশি ক্রেতারা আমাদের কাছে পরিস্থিতি জানতে চাচ্ছেন। তাদেরকে আমরা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি,” চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) এই পরিচালক।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের রপ্তানির ৮৪ শতাংশই তৈরি পোশাক খাত থেকে।
“এমনিতেই আমাদের রপ্তানির অবস্থা ভালো নয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হলে বিদেশি ক্রেতারা শঙ্কিত থাকবেন, তারা কারখানা পরিদর্শন করতে চাইবেন না। এতে রপ্তানি ব্যাহত হবে,” বেনারকে বলেন পোশাক খাতের আরেক সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
সহিংসতা হলে পোশাক শিল্প ‘টিকতে পারবে না’
ঢাকার অদূরে নরসিংদীর আবেদ টেক্সটাইল প্রসেসিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বেনারকে বলেন, “গ্যাস-বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ক্রয়াদেশ কম হওয়ায় শিল্প অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। এমন অবস্থায় নির্বাচন ঘিরে উদ্বেগ রয়েছে।”
“বর্তমানে বস্ত্র খাতের কঠিন পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা হলে এই শিল্প টিকতে পারবে না,” যোগ করেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জের মিথিলা টেক্সটাইল মিলস-এর চেয়ারম্যান আজহার খান বলেন, “এ বছরটা আমাদের জন্য খুবই কঠিন সময়। একে তো গ্যাস সংকট, ক্রয়াদেশ কমছে; অতীতের বছরগুলোর তুলনায় অর্ধেক কাজ করছি। এর মধ্যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।”
নির্বাচনের বছর অর্থনীতিতে গতিমন্থরতা আসে, এবার তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের বছরে বিনিয়োগ কমে যাবে বলে মনে করছেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান।
ইতোমধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি ঘিরে নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ও অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন। গত ১১ জুলাই মার্কিন দূতাবাস ও অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশন তাদের ভ্রমণ সতর্কবার্তা হালনাগাদ করে এই সতর্কতা জারি করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশের রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি একদফার আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে সংবিধান অনুযায়ী, দলীয় সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনের এক দফায় অনড় সরকারি দল আওয়ামী লীগ।
এই ইস্যুতে গত কয়েক মাস ধরে উভয় দলের পাল্টাপাল্টি মিছিল-সমাবেশ, হামলায় দলীয় কর্মী নিহতের ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ ১৮ জুলাই দেশব্যাপী বিএনপির পদযাত্রাকে ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে, লক্ষ্মীপুরে নিহত হন মো. সজিব নামে কৃষক দলের এক কর্মী।
এমন পরিস্থিতিতে আগামী ২৭ জুলাই ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের দিন আওয়ামী লীগের তিন সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এই পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ঘিরে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

শঙ্কিত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা
কেবল বড়ো রপ্তানিকারক নন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যেও চলমান পরিস্থিতি ও আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
রাজধানীর আরামবাগ এলাকায় অবস্থিত সিফাত ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি এক্সেসরিজ ও প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আলমগীর মানিক বেনারকে বলেন, “আগামী দিন নিয়ে আমরা শঙ্কিত। কোভিডের ধাক্কা এখনো পুরোপুরি সামলে উঠতে পারিনি। এর পরে বিদ্যুতের সমস্যা, এখন আবার শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।”
“নির্বাচন নিয়ে উভয় দলের মধ্যে সংঘাত, হরতাল-অবরোধ আসলে আমরা উৎপাদন কাজ কিংবা পণ্য কীভাবে পাঠাব!” বলেন তিনি।
এমন অবস্থা তৈরি হলে এবার রাস্তায় নামার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চাই।”
অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরও মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে এর বড়ো আঘাত আসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর।
অর্থনীতি-রাজনীতি দুটোই খারাপের দিকে যাচ্ছে
ড. আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, “দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি—দুটোই আগামী দিনগুলোতে খারাপের দিকে যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “ভালোই অনিশ্চয়তা আছে। এটি (আগামী নির্বাচন ঘিরে চলমান পরিস্থিতি) ছোটখাটো ইস্যু নয়।”
এ ধরনের পরিস্থিতিতে দেশ থেকে অর্থপাচার বাড়তে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “টাকা পাচার বাড়তে পারে, বিনিয়োগ থমকে যাবে।”
এছাড়া রপ্তানিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এই সমস্যার সমাধান উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আগের বারের মতো (২০১৮ ও ২০১৪ সাল) নির্বাচন করে হয়তো পার পাওয়া এত সহজ হবে না।”
“এটা আমাদের রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা যে, তারা একটা নির্বাচন ঠিক মতো করতে পারেন না। প্রত্যেক নির্বাচনের আগে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়,” যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশের ঋণমান নেতিবাচক, ব্যয় বাড়বে বিদেশি ঋণের
দেশের অর্থনৈতিক গতিমন্থরতা এবং ক্রমাগত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার মধ্যে আরেকটি নেতিবাচক খবর দিলো বৈশ্বিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল।
সংস্থাটি মঙ্গলবার বাংলাদেশের ঋণমান আভাস ‘স্থিতিশীল’ থেকে কমিয়ে ‘নেতিবাচক’ হিসেবে নির্ধারণ করেছে। একইসঙ্গে দেশের সার্বভৌম ঋণমান দীর্ঘ মেয়াদে ‘বিবি মাইনাস’ ও স্বল্প মেয়াদে ‘বি’ নির্ধারণ করেছে তারা।
সংস্থাটির প্রকাশিত রেটিংয়ে বলা হয়, “বাংলাদেশের তারল্য অবস্থান আগামী এক বছরে আরও খারাপ হতে পারে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মধ্যে থাকবে।”
দেশের আমদানি ব্যয় বাড়ায় এ সময় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক-তৃতীয়াংশ কমেছে বলে উল্লেখ করা হয় এই প্রতিবেদনে।
এতে আরও বলা হয়, “ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ সরকার আমদানি করা জ্বালানির মূল্য পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকর সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “বৈশ্বিক সংস্থা কর্তৃক ঋণমান কমলে বাংলাদেশের সরকারি কিংবা বেসরকারি খাতকে বিদেশি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সতর্ক হয়ে যায়।”
“এ কারণে ঋণের সুদের হারও বেড়ে যায়,” বলেন তিনি।
এর আগে গত ৩১ মে আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী আরেকটি প্রতিষ্ঠান মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান কমানোর কথা জানায়।