অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে প্রথমবারের মতো জামিন পেলেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের দুই মন্ত্রী

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.10.09
ঢাকা
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে প্রথমবারের মতো জামিন পেলেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের দুই মন্ত্রী সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও সুনামগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ মান্নানকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের হাসপাতাল থেকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করছেন কারারক্ষীরা। ৮ অক্টোবর ২০২৪।
[বেনারনিউজ]

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এই প্রথম ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দুই নেতার জামিনে মুক্তির ঘটনা ঘটল।

শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক দুই মন্ত্রী, সাবের হোসেন চৌধুরী এবং এম এ মান্নান পৃথক আদালত থেকে হত্যা মামলায় জামিন পেয়ে গত মঙ্গলবার থেকে বুধবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কারাগার থেকে ছাড়া পান।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হলেও এই দুই নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি, মানুষের কাছে তাঁদের মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও উপদেষ্টাসহ দলের শীর্ষস্থানীয় অর্ধশত নেতা গ্রেপ্তার হয়ে জেলে রয়েছেন। কিন্তু মান্নান ও সাবের গ্রেপ্তার হওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের ব্যাপক সমালোচনা হয়।

আওয়ামী লীগের অনেক নেতা স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে জামিনের আবেদন করলেও দেশের বিভিন্ন আদালত তা গ্রহণ করেনি। অসুস্থ দাবি করা অনেককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বরং রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তবে বুধবার সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নানকে স্বাস্থ্যগত কারণে সুনামগঞ্জ জেলা আদালত জামিন দেয় বলে সাংবাদিকদের জানান তাঁর আইনজীবী আব্দুল হামিদ।

এর আগে মান্নানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে তার এলাকার মানুষ বিক্ষোভ করেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের আর কোনো নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর এমনটি হয়নি।

সাবেক পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেনও মঙ্গলবার ঢাকার একটি আদালত থেকে অসুস্থতাজনিত কারণে ছয়টি মামলায় জামিন পান।

‘ইতিবাচক ঘটনা’

সাবের হোসেন চৌধুরী ও এমএ মান্নানের জামিন পাওয়াকে ‘ইতিবাচক ঘটনা’ উল্লেখ করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান জেড. আই. খান পান্না বুধবার বেনারকে বলেন, অজামিনযোগ্য ধারায় কোনো আসামিকে জামিন দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার আদালতের। এসব ক্ষেত্রে জামিন প্রদানে সাধারণত অসুস্থতা, বয়স, নারীসহ অন্যান্য মানবিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে থাকেন আদালত।

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেমন দেখা গেছে, তেমনি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আমরা দেখলাম ঢালাওভাবে মামলা দেয়া ও গ্রেপ্তারের ঘটনা। এমনকি আটক নেতাদের জামিন দেওয়া হচ্ছিল না, অসুস্থ হলেও না। সাবের সাহেব এবং মান্নান সাহেবকে জামিন প্রদানের মাধ্যমে সেই প্রবণতা আপাতত বন্ধ হলো বলা যায়। এতে আদালতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হলো।”

“এছাড়া, এই দুইজন নেতার পাবলিক ইমেজ ভালো। আদালত হয়তো এটিও আমলে নিয়ে তাঁদের জামিন দিতে পারেন,” যোগ করেন তিনি।

ad790135-2a07-4331-83e1-457033351529.jpeg
সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করছে পুলিশ। ৭ অক্টোবর ২০২৪। [মেহেদী রানা/বেনারনিউজ]

সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া আটক ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’

রাজনৈতিক কারণে রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের আটক করে কারাগারে পাঠানোর নীতি বাংলাদেশে নতুন নয়। দেশের দুই বৃহৎ দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে এই নীতি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে ক্ষমতাসীনরা।

তবে এক্ষেত্রে গত ১৫ বছর শেখ হাসিনার শাসনামলে এই প্রবণতা চরম আকার ধারণ করে। বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে দুর্নীতি মামলায় জামিন না দিয়ে কারাগারে রাখা হয়।

দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতাদের আটকে রেখে জাতীয় নির্বাচন করা হয়।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সারাদেশে প্রায় সকল পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বুধবার বেনারকে বলেন, “এমন কাজ আওয়ামী লীগ আমলেও ব্যাপকভাবে করা হয়।”

তাঁর মতে, এসব মামলার “অনেকগুলো সত্য, আবার অনেক মামলায় আটক নেতাদের সংশ্লিষ্টতা নেই বলা যায়।”

সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে “আওয়ামী লীগ করা ছাড়া আর কোনো অভিযোগ আনা হলে দেশের মানুষ বিশ্বাস করবে না,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমএ মান্নানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সুনামগঞ্জে বিক্ষোভ হয়েছে। “দেশের অন্য কোনো স্থানে আটক কোনো মন্ত্রী-এমপি আটকের ঘটনায় এমনটা ঘটেনি।”

এসব বিষয়ে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বুধবার বেনারকে বলেন, “নো কমেন্ট।”

গত ৫ আগস্টের পর থেকে দলের সব পর্যায়ের নেতাদের হত্যা মামলা আসামি করে জেলে পাঠানো হয়েছে বলে অজ্ঞাত স্থান থেকে বেনারকে বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ.ফ.ম. বাহাউদ্দিন নাসিম।

তিনি বলেন, “আমাদের দলের সিনিয়র নেতাদের রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। অসুস্থ হলেও জামিন দেওয়া হচ্ছে না। তবে সাবের হোসেন যে জামিন পেয়েছেন সেটি ভালো খবর। জামিন পাওয়া একজনের অধিকার।”

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বুধবার বেনারকে বলেন, “অভিযোগ ছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশ রিমান্ড চাইলেই আদালত তা মঞ্জুর করত। আবার এখনও হত্যা মামলা হওয়ার সাথে সাথে আসামিকে আটক করা হচ্ছে এবং জামিন না মঞ্জুর করে রিমান্ডে পাঠানো হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে অসুস্থতা বিবেচনা করা হয়নি।”

“তবে ব্যতিক্রম ঘটল সাবের হোসেন চৌধুরী এবং এম এ মান্নানের ক্ষেত্রে। তাঁরা দুজনই অসুস্থ ছিলেন। হয়তো সেকারণেই আদালত তাঁদের জামিন দিয়েছে,” বলেন কামাল উদ্দিন।

“কারও বিরুদ্ধে মামলা হলেই তাঁকে আটক করা যাবে না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও এ কথা পরিষ্কার করে বলেছেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া আটক করা মানবাধিকার লঙ্ঘন। আশা করি, আদালত বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন,” যোগ করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।