কাজ শেষের আগেই মেগাপ্রকল্প উদ্বোধন, উন্নয়ন দেখিয়ে ভোট চাচ্ছে আওয়ামী লীগ
2023.10.12
ঢাকা

বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে অনড় প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যখন সরকার পতনের একদফা দাবিতে আন্দোলন করছে, অন্যদিকে তখন বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প আংশিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রচার শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
“আওয়ামী লীগ দেশে উন্নয়ন করেছে,” মন্তব্য করে গত ১০ অক্টোবর পদ্মাসেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আংশিক উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে এগিয়ে নিতে আগামী নির্বাচনে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা না হলে নির্বাচনে যাবে না এবং তাদেরকে বাদ দিয়ে দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা করেছে বিএনপি।
তবে ক্ষমতাসীন নেতাদের মতে, বিএনপির নির্বাচনে আসা না আসা নিয়ে চিন্তিত নন তাঁরা। গত ১৫ বছরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে আগামী সংসদ নির্বাচনে মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে।
গত মাস থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। চলতি মাসেও উদ্বোধনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে।
মাসের শেষের দিকে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত টানেল এবং ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্প উদ্বোধন করবেন তিনি।
পাশাপাশি, দলের আগামী নির্বাচনী ইশতেহার প্রস্তুতের কাজ চলছে বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান।
“গত পাঁচ বছর আমরা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, সেগুলোর কতগুলো বাস্তবায়ন করেছি তা থাকবে ইশতেহারে। এই পাঁচ বছরের প্রতিশ্রুতির মধ্যে মেগা প্রকল্পগুলোও রয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়নে সরকার কতটুকু কাজ করেছে তা আমরা নির্বাচনের সময় জনগণকে জানাব,” বলেন ফারুক খান।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন বৈঠকে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দেশের মানুষকে আরও বেশি করে জানানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে বলেও দলীয় নেতারা জানান।
এদিকে আন্তর্জাতিক সংস্থা এনডিআই ও আইআরআই’র যৌথ উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী প্রতিনিধিদল আগামী কাল ঢাকায় তাদের কর্মসূচি সমাপ্তি টানবে।
বাংলাদেশে আসন্ন “নির্বাচনী প্রস্তুতির পরিস্থিতির স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন” করতে দলটি গত ৮ অক্টোবর থেকে দলটি প্রধানমন্ত্রী, সরকারি ও বিরোধীদল, নির্বাচন কমিশন, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে বৈঠক করেছে।
তবে এখন পর্যন্ত প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর যত উদ্বোধন
২০২২ সালের জুন মাসে ৩২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশীয় অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সড়ক পথে সরাসরি যুক্ত করা হয়। ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি এবং চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো।
গত বছরের ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের আংশিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। জাপানের অর্থায়নে নির্মিত এই প্রকল্পে খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
চলতি মাসের শেষে তিনি উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল সেবার উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। যদিও এখনই মেট্রোরেলের অনেক স্টেশনে এই সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না।
প্রকল্পের পুরো অংশ শেষ না হলেও গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে চীন ও ইতালির যৌথ অর্থায়নে নির্মিত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। আট হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।
গত ৫ অক্টোবর রাশিয়ার অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জ্বালানি ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
রাশিয়ার ঋণে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের বর্তমান ডলার মূল্যে খরচ প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মার্কিন ডলারে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।
গত ৭ অক্টোবর জাপানের অর্থায়নে নির্মিত ২১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের একাংশ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী, ১০ অক্টোবর আংশিক উদ্বোধন করেন পদ্মা রেলসেতু।
প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চীনা ঋণে নির্মিত পদ্মা রেলসেতু বাস্তবায়ন করছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড। ২০২৪ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা রয়েছে।
চলতি মাসের শেষ দিকে তাঁর কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত টানেল উদ্বোধনের কথা রয়েছে। টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে। ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে, চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)।
‘উন্নয়ন দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিস্থাপিত করা যায় না’
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বুধবার বেনারকে বলেন, “এবার আওয়ামী লীগের স্লোগান হলো ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র।’ অর্থাৎ আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে উন্নয়ন প্রকল্প ছাড়া কোনো কথাই নেই। আওয়ামী লীগ আর গণতন্ত্রের কথা বলে না।”
গত দুই মাসে উদ্বোধন করা প্রকল্পগুলোর মধ্যে “একমাত্র পদ্মা সেতু ছাড়া অধিকাংশ মেগা প্রকল্পই পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই উদ্বোধন করা হচ্ছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচনকে মাথায় রেখেই এগুলোকে উদ্বোধন করা হচ্ছে।”
তবে তাঁর মতে, এই ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের কথা “রাজনীতিতে” বা আগামী নির্বাচনের মাঠে ব্যবহার “করে তেমন কোনো লাভ হবে না।”
তিনি বলেন, “যেসব উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একমাত্র পদ্মা সেতু ছাড়া কোনো প্রকল্পের কথা জনগণ তেমন আমলে নেবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনকে অনেক ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।”
“উন্নয়নের গণতন্ত্রের নামে যে রাজনীতির কথা আওয়ামী লীগ বলছে, সেটি আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে,” বলে মনে করেন অধ্যাপক নিজাম।
“কারণ এই মেগা প্রকল্পগুলোর প্রায় সবগুলোই বিদেশি ঋণে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এগুলোর কিস্তি যখন শুরু হবে, তখন আমাদের দেশের অবস্থা কী হবে সে বিষয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে,” বলেন তিনি।
তাঁর মতে, “উন্নয়ন দিয়ে কখনো গণতন্ত্রকে প্রতিস্থাপিত করা যায় না।”
এদিকে “গণতন্ত্র ছাড়া কোনো উন্নয়ন প্রকল্পই দেশের মানুষের কাছ থেকে একটি অগণতান্ত্রিক সরকারকে রক্ষা করতে পারবে না,” বলে বৃহস্পতিবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিন স্বপন।
তিনি বলেন, “প্রকল্পগুলোর আংশিক উদ্বোধন করে তাঁরা কী করেছে সেগুলো দেখাতে চাচ্ছে। দেশের মানুষ সেগুলো আমলে নেবে না।”