অন্তঃকোন্দলে আওয়ামী লীগে বেড়েছে খুন
2024.07.12
ঢাকা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিবাদ এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে মতে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা প্রায় ৩০০ শতাংশ বেড়েছে।
আসকের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৪১ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন তিন হাজার ৭৩৬ জন। এর মধ্যে কেবল গত মাসেই রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন আটজন। যেখানে গত বছরের প্রথম ছয় মাসে এই ধরনের সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনা ছিল ১৪টি এবং আহত হয়েছিলেন দুই হাজার ৪২২ জন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন ও পরবর্তীতে গত জুন মাসে শেষ হওয়া উপজেলা নির্বাচনের কারণে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বেড়ে যাওয়া এসব সহিংসতার প্রধান কারণ।
সব স্তরে সুশাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারলে এই ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা কমানো যাবে বলে তাদের অভিমত।
সর্বশেষ গত ৮ জুলাই রাতে খুলনা নগরীর পূর্ব বানিয়াখামার লোহারগেট এলাকায় ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আল-আমিনকে (৪৫) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এ ব্যাপারে খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল হোসেন বেনারকে বলেন, “আল-আমিন স্থানীয় মুন্নার গ্যারেজে এসে বসামাত্র দুর্বৃত্তরা তাঁকে কুপিয়ে জখম করে। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।”
খুলনা নগরীতে আল-আমিন খুন হওয়ার মাত্র দুই দিন আগে ৬ জুলাই রাতে ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম রবিকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।সহিংসতার
প্রধান কারণ অভ্যন্তরীণ কোন্দল
স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। যার প্রায় সবগুলোই ঘটেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলের জেরে।
আসকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির অবরোধ কর্মসূচিতে যোগ দিতে গিয়ে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। তবে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বিএনপির অন্তঃকোন্দলে কেউ হত্যার শিকার হননি।
খুলনা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান বেনারকে বলেন, “ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম হত্যার ঘটনায় তাঁর স্ত্রী শায়লা ইরিন বাদী হয়ে ডুমুরিয়া থানায় একটি মামলা করেন। এজাহারে আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ হয়নি। তবে শায়লা ইরান অভিযোগ করেছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব থেকে রবিউলকে খুন করা হতে পারে।”
এই ঘটনায় পুলিশ ইতোমধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য আজগর বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছেন সাঈদুর।
জুনের শেষ সপ্তাহে যেসব আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—আওয়ামী লীগের রাজশাহী বাঘা উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পরিষদের সদস্য ও আওয়ামী লীগের নয়ালভাঙ্গা ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম এবং নারায়ণগঞ্জের কাশিপুর ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদক সুরুজ মিয়া।
গত ২২ জুন উপজেলা দলিল লেখক সমিতির নামে অতিরিক্ত টাকা আদায়কে কেন্দ্র করে বাঘায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল ২৬ জুন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। আশরাফুলের মৃত্যুর ঘটনায় রাজশাহী-৬ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের মধ্যে বাগযুদ্ধ সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত গড়ায়।
অস্বস্তিতে আওয়ামী লীগ
ক্রমবর্ধমান সহিংসতার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলটিকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছে। দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানিয়েছেন, এসব ঘটনায় তাঁরাও বিব্রত।
সূত্র জানিয়েছে, তৃণমূলে সংঘাত দূর করতে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা দেশের বিভিন্ন এলাকা সফরের কথাও ভাবছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বেনারকে বলেন, “তৃণমূল পর্যায়ে দলের হাইকমান্ডের বার্তা পৌঁছে দিতে সাংগঠনিক সফরের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িত কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না, কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম এই সংঘর্ষকে রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য নয়, ব্যক্তিগত শত্রুতা বলে অভিহিত করেছেন।
সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়ালে দেশের প্রচলিত আইনের পাশাপাশি কঠোর দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, “আশা করি, আগামী দিনে সংঘাত কমে আসবে।”
সহিংসতা আরও বাড়ার শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
বিএনপি ও অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী রাজনৈতিক দলের বয়কটের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজেদের নেতা-কর্মীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ উন্মুক্ত করে দেওয়ায় এবং পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে কোনো প্রার্থী মনোনীত না করে সবাইকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ সংঘাত বেড়েছে।
আসকের পরিসংখ্যান অনুসারে, উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দলে অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের বেআইনি কর্মকাণ্ডের কারণে আওয়ামী লীগে অন্তঃকোন্দল বাড়ছে।
দলটি সব পদ নিজেদের হাতে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “উপজেলা নির্বাচনের আগে সংসদ সদস্যদের লাগাম টেনে ধরতে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে সহিংসতা বন্ধের বদলে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “সরকারের কোনো পর্যায়েই এখন সুশাসন নেই এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রায় সব ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ বেনারকে বলেন, “কেউ যদি উপজেলা চেয়ারম্যান, এমপি বা আওয়ামী লীগ নেতা হতে পারে, তাহলে সে অবৈধ পন্থায় বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারে। তাই সবার মধ্যেই পদ পাওয়ার লোভ জেঁকে বসেছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে, গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরা,” বলেন তিনি।