জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়, দেশের বেশিরভাগ এলাকা অন্ধকারে

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.10.04
ঢাকা
জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়, দেশের বেশিরভাগ এলাকা অন্ধকারে জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের ফলে বিদ্যুৎবিহীন ঢাকার রাস্তা। ৪ অক্টোবর ২০২২।
[রয়টার্স]

জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের ফলে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের ৪৮ জেলার ১২ কোটির বেশি মানুষ মঙ্গলবার বিদ্যুৎবিহীন দিন কাটিয়েছেন।

রাত সাড়ে এগারোটায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি বলে জানিয়েছেন পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।

যদিও এর আগে তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক জানিয়েছিলেন, রাত আটটার মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক (জনসংযোগ) শামীম হাসান বেনারকে বলেন, বেলা দুইটা পাঁচ মিনিটের দিকে হঠাৎ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ এলাকায় জাতীয় গ্রিডে ক্রুটি দেখা দিলে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ বাদে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেটসহ দেশের কমপক্ষে ৩০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি বলেন, “আমাদের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা এমন যে গ্রিডে সমস্যা হলে এর সাথে সংযুক্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয় এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আবার চালু হতে বেশ সময় লেগে যায়।”

বিকাল থেকে ঢাকার কিছু এলাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হতে শুরু করে বলে জানান শামীম হাসান।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের প্রধান প্রকৌশলী মোরশেদ আলম খান রাত ১১টার দিকে বেনারকে বলেন, “রাত নয়টার দিকে সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াটে এসে দাঁড়ায়। আমরা এখন পর্যন্ত প্রায় আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পেরেছি।”

তিনি বলেন, “বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কারিগরি কারণে বন্ধ হয়ে গেলে সাথে সাথে উৎপাদনে আনা যায় না। এর জন্য সময় দরকার। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করে যাচ্ছি, পুরোপুরি ঠিক হতে কিছুটা সময় লাগবে।”

গত মাসে কয়েক ঘণ্টার গ্রিড বিপর্যয়ের পর এটিই জাতীয় গ্রিডে বড়ো বিপর্যয়।

২০১৪ সালে জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণে দেশে কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা একটানা বিদ্যুৎবিহীন দিন কাটায় দেশের মানুষ।

মঙ্গলবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটকে প্রথমে সাধারণ লোডশেডিং মনে করলেও জাতীয় গ্রিডের বিপর্যয়ের খবরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ।

বেলা তিনটার পর থেকে হাজার হাজার যানবাহন ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তায় বের হতে থাকে। সেগুলো পেট্রোলপাম্প ও সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনে ভিড় করতে শুরু করে। শুরু হয় যানজট।

সন্ধ্যার পর পুরো ঢাকা শহর অন্ধকারে ঢেকে যায়। যানবাহনের লাইট ছাড়া আর কোনও আলো ছিল না রাস্তায়। মোবাইল-ইন্টারনেট সেবায়ও বিঘ্ন ঘটে।

ঢাকায় বিভিন্ন আবাসিক ভবনে পানি ধরে রাখার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। লিফট না থাকায় বহুতল ভবনের উপরের তলায় বসবাসকারীদের হেঁটে উঠতে হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটে হাসপাতালগুলোর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে থাকে।

পরিচালক শামীম হাসান বলেন, জাতীয় গ্রিডে কেন বিপর্যয় ঘটল তা জানতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বিদেশ সফররত জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ফেসবুক পোস্ট ও মোবাইল বার্তার মাধ্যমে দেশবাসীকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানান।

dhaka2.jpeg
মোমবাতি জ্বালিয়ে বিদ্যুৎবিহীন ঢাকায় বেচাকেনা করছেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা। ৪ অক্টোবর ২০২২। [রয়টার্স]

পেট্রোলপাম্প ও সিএনজি স্টেশনে ভিড়

বিকাল তিনটায় সরকারি অফিস ছুটি হলে ঢাকার রাস্তায় সিএনজি চালিত বেবিট্যাক্সির ব্যাপক চাহিদা থাকে। তবে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে চালকদের অনেকে যাত্রী বহন না করে ভিড় করতে থাকেন সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোতে।

জ্বালানী সংগ্রহ করতে ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়ির চালকেরাও চলে আসেন সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন ও পেট্রোলপাম্পগুলোতে।

বেবি চালক শামসুল হক বেনারকে বলেন, “যদি বিদ্যুৎ আজ না আসে তাহলে কাল গ্যাস থাকবে না। গ্যাস না থাকলে আগামীকাল তো ভাড়া মারতে পারব না। তাই, আজকে প্যাসেঞ্জার না নিয়ে গ্যাস নিতে এসেছি।”

ঢাকার এলেনবাড়ি এলাকার ট্রাস্ট ফিলিং স্টেশনের কর্মী মো. সুমন বেনারকে বলেন, “আজ বিকালে থেকেই হঠাৎ করে গাড়ি, মোটরসাইকেলের ব্যাপক ভিড় শুরু হয়। আমরা জেনারেটর দিয়ে মেশিন সক্রিয় রেখে তেল বিক্রি করছি। মানুষ সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি।”

মোমবাতির জন্য কাড়াকাড়ি

মিরপুর সাড়ে এগারো এলাকার মুদি ব্যবসায়ী মো. মিজান বেনারকে বলেন, “বিকাল থেকেই মানুষ আমার দোকানে এসে সব মোমবাতি নিয়ে গেছেন। একেকজন ক্রেতা পাঁচ-ছয়টি মোমবাতি ক্রয় করেছেন।”

নাখালপাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. হাশেম বেনারকে বলেন, “বিদ্যুৎ না থাকলে মোমবাতি ছাড়া উপায় নেই। বিদ্যুৎ কখন আসবে সেটি বলা যাবে না। ২০১৪ সালের মতো যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকে তখন কী হবে? মোবাইল বন্ধ হয়ে যাবে। ফ্রিজের খাবার নষ্ট হয়ে যাবে। একেবারে জীবন স্থবির হয়ে পড়বে।”

বহুতল ভবনে কষ্ট

ঢাকার স্বামীবাগ এলাকায় একটি নয়তলা ভবনে বসবাস করেন আজিজুর রহমান। তিনি বেনারকে বলেন, বেলা দুইটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত জেনারেটর দিয়ে লিফট চালু ছিল। এরপর জেনারেটর বন্ধ করে দেয়া হয়।

তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ না থাকলে ওপরের তলায় পানি ওঠে না। আমি নিচ থেকে বালতি করে পানি তুলেছি। দুই বালতি পানি তুলে আর তুলতে পারিনি।”

আজিজুর রহমান বলেন, রাত নয়টার পর স্বামীবাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় শুরু হয়।

তিনি বলেন, “বিদ্যুতের অভাবে অন্ধকার ও গরমের মধ্যে এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে আমরা কয়েক ঘণ্টা কাটিয়েছি। শহরের জীবন কতটা অসহায়ের কয়েক ঘণ্টার বিদ্যুৎ বিভ্রাটে তা আরেকবার বোঝা গেল।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।